সন্ধ্যামণি ঝোপের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে টুপাই পুকুরে জাল ফেলা দেখছিল। আক্কাসদাদু বুক জলে দাঁড়িয়ে অভ্যস্ত হাতে ছুঁড়ে ফেলছে জালটা। কিছুক্ষণ পরে, আস্তে-আস্তে সুতো গুটানোর মতন করে তুলে আনছে সেটাকে। ধরা পড়ছে কত-কত মাছ। এ’কদিনে অনেক মাছ ধরা দেখেছে টুপাই। আক্কাসদাদু একবার ওকে কোমর অবধি জলে নামিয়েছিল। মেজমামার সেকি লাফালাফি পাড়ে দাঁড়িয়ে। তিনি এমনিতেই ভীতু মানুষ। সাঁতার না জানা ভাগ্নেকে অন্যের হাতে জলে ছাড়তে তাঁর বেজায় আপত্তি। অথচ নিজেরও নামার সাহস নেই। টুপাই অবশ্য গা করেনি। জাল ছুঁড়তে না পারলেও দড়ি ধরে গুটাতে সাহায্য তো করাই যায়। এমন সুযোগ আর কখনও পাওয়া যাবে না। সেই মতন জাল তুলে এনে তা থেকে মাছ ছাড়ানো। সেগুলোকে হাঁড়িতে করে কলতলায় নিয়ে যাওয়া। মায়ের ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে বিরাট আঁশবটিতে মাছ কাটা দেখা। অবশেষে, বড় মামিমার কাছে আবদার করে ভাজা মাছ খাওয়া। এমন কত মজাদার মেছো কারবারই না করা যায় বকুলগঞ্জে এলে। মামাবাড়ি মানেই জম্পেশ আনন্দ। প্রতিবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময়েই যত মনখারাপ এসে জড় হয়। এখন যেমন তপিল নদীর চরা ধরে, কাশঝাড়ের পাশে কাঁচা পথ বেয়ে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজে টুপাইয়ের বুক চিনচিন করছে। ঢাকিরা বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। এ’বছরের মতন দুগ্গা মা কৈলাস পর্বতে ফেরত চলে গেছেন। ছুটিছাটাও শেষ। ব্যাগ, সুটকেস রিক্সায় তুলছে বাবা। মা সেই কখন থেকেই পাড়াশুদ্ধু লোককে ছলছলে চোখে ‘আসি গো’ বলে এক পাও এগোচ্ছে না। শুধু টুপাই নয়, আজ সকলেরই মনখারাপ, এমনকি ক’দিনেই চেনা জংলী ফুলগুলোরও। ওদেরও কি মন আছে নাকি?
‘এইযে বাবু,
এখনও জাল ফেলা দেখা হচ্ছে? মাছ ধরার আশ মেটেনি বুঝি। ওদিকে ঘরে ব্যাগ ফেলে রেখে এসেছেন।
এদেরকে না, মারতে হয় খুব জোরে।’
মাথায় সজোরে
গাঁট্টা খেল টুপাই। ফিরে তাকানোর আগে আলগোছে মুছে নিল চোখ। মন
কেমনের কথা সবাইকে জানান দিতে চায় না সে। এখন কি আর ও ছোট আছে যে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে
কেঁদে ভাসাবে কচি বয়সের মতন। ছুটির শেষে কলকাতা যেতে সে এক কাণ্ড বাধাত টুপাই। বকুলগঞ্জের
সকলের কানে যেত ওর কান্নার স্বর। নয়ানজুলি, পুকুর আর নদীতে ঘেরা এই গ্রামটা যে তার
খুব প্রিয়। কিন্তু এবারে মা-বাবা আসতেই চায়নি। টুপাই জোর করেই নিয়ে এসেছে ওদেরকে।
‘উফ্, এত জোরে
কেউ মারে?’ মাথায় হাত বুলিয়ে মনখুশিকে ভুরূ কুঁচকে বলল টুপাই।
মেয়েটা খুব ডানপিটে। টুপাইকে ভালো মানুষ পেয়ে চাটি, গাঁট্টা লাগিয়েই রেখেছে। দু’দিন
আগে ছাদ থেকে আধ খাওয়া নাসপাতির টুকরো ছুঁড়ে মেরেছিল। টুপাই তখন
একমনে ঠাকুর দালানে দাদামশাইয়ের নবমী পুজো দেখছে। নাসপাতি এসে পড়লো ওর ব্রহ্মতালুতে।
প্রথমে রীতিমত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। তারপরে, রেগেমেগে, ধুপধাপ করে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে
উঠে দেখে মেয়েটা খুশিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। গ্রামের সবুজ হাওয়ায়, শরতের শিশিরে ভেজা,
এলোমেলো চুল সামলাতে-সামলাতে মনখুশি বলল, ‘কেমন টিপ দেখলি?’ টুপাই গোমড়া মুখে বলেছিল,
‘আমি চলে গেলে কাকে মারিস দেখবো। খালি তোর কথায়-কথায় খিল্খিল্। এত হাসে নাকি কেউ
অকারণে? মহা বিরক্তিকর অভ্যেস।‘ কড়া কথা শুনিয়েও কোনো লাভ হয় না। একটু পরেই যেই কে
সেই। এখন আবার গাঁট্টা মেরে এমন কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন টুপাই বিরাট কিছু
কেলেঙ্কারি বাধিয়ে বসেছে।
‘মারব না কেন?
আমি পরশুদিন পুজোর সাজগোজ ভুলে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গল্পের বইগুলো খুঁজে বের করলাম।
তারপরে, সুন্দর করে গুছিয়ে, ব্যাগে ভরে কালকে দিয়ে গেলাম তোর হাতে। সেগুলোর কোনো মূল্যই
দিলি না। আমি ঠিক জানতাম, তুই ভুলবি, গবেট কোথাকার। রিক্সার প্যাক্-প্যাকানি শুনেই
আমি এক ছুটে দোতলায় তোদের ঘরে গিয়ে দেখি ঠিক তাই। বিছানায় ফেলে রাখা আছে ব্যাগটা,’
প্রবলভাবে দু’হাত নেড়ে আর কানের দুল ঝাঁকিয়ে অভিমান বুঝিয়ে দিল মনখুশি। পুজোর মধ্যে
এক দিন টুপাই ওকে বলেছিল বই পড়ার শখের কথা। মেয়েটা সেটা মনে রেখে, সারা গ্রাম ঘুরে
খান দশেক বই জোগাড় করে এনেছে। নিজের বাড়ি হোক বা পড়শির ঘর, কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি
সে। টুপাই যদি বলে বসে, বকুলগঞ্জে কেউ বই পড়েনা, তাহলে মনখুশির মাথা হেঁট হয়ে যাবে
না?
‘হ্যাঁরে, তোর
সবকটা পড়া হয়ে গেছে? আমায় যে দিয়ে দিলি বড়। আপসোস করবি না তো পরে?’ টুপাই ঘাস ঝাড়তে-ঝাড়তে
উঠে দাঁড়ালো। মনখুশি, নিজের হাতে বানানো, খুব সুন্দর একটা ঝোলা’তে নিয়ে এসেছে বইগুলো।
ওর হাত থেকে সেটা নিয়ে পায়ে-পায়ে রিক্সার দিকে এগোতে শুরু করলো টুপাই। মেয়েটা ওর পিছুপিছু।
ওকে জানতে দিলে হবে না, সে ইচ্ছে করেই ফেলে রেখে এসেছিল ব্যাগটা। এগুলো ফেরত দিতে আর
কি আসা হবে? পাগলি মেয়ে, কিছুই বোঝে না। এ’কদিন সারাক্ষণ ছায়ার মতন লেগেছিল সাথে। মিছিমিছি
মায়া বাড়ায় দস্যিপনা করে।
‘মাত্র একটা
পড়েছি। তোদের শহরে কাজ-কম্ম কারোর থাকে না বাপু। তাই লোকে খালি বসে-বসে বই পড়ে দিগ্গজ
হয়। আমি এখানে কুল পেড়ে, পেয়ারা খেয়ে হয়রাণ হয়ে যাই। আমার পড়ার সময় কোথায়?’
মনখুশির কথায়
হেসে ফেলে টুপাই। খেলাধুলার সময় যেমন মাতব্বরি, কথা বলার সময়
তেমনই পাকা বুড়ির মতন হাবভাব ওর। পৃথিবীর সবকিছুই যেন জেনে বসে আছে সে। গোবেচারা ছেলেটা
ওর কাছে নেহাতই দুধভাত। দিদিমার কাছ থেকে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে সকলের সাথে বসে ফল
কাটছিল সপ্তমীর দিন। টুপাই বারান্দায় বসে চুপটি
করে ওর ছবি এঁকে নিয়েছিল এক ফাঁকে। আজ সকালে মা’কে লুকিয়ে ছবিটা রেখে দিয়েছিল ফেলে
আসা বইয়ের পাতার ভাঁজে। হায় রে, এই ঝোলার সাথে সেটাও নিশ্চয়ই ফেরত এলো ওর কাছে।
‘হাসছিস কেন
রে?’ চোখ পাকিয়ে জানতে চাইল মনখুশি। ওকে নিয়ে মস্করা বেজায় অপছন্দ মেয়েটার। মনখুশির
এবং টুপাইয়ের মায়েরা মেয়েবেলার বন্ধু। তাই মল্লিক বাড়ি মনখুশির নিজের না হলেও নিজের
থেকেও বেশি। এই বাড়ির দরজা তার জন্যে সর্বদাই খোলা। সবার সাথে মনখুশির যেমন ভাব তেমন
ঝগড়াও। দাদামশাই বা দিদিমা মাঝেমধ্যে ওকে নাতবউ বলে খেপায়। মামিরাও তাল দেয় ওদের সাথে।
মনখুশি কিন্তু রেগে স্বয়ং লক্ষ্মীবাঈ হয়ে যায়। মুক্তোর মালা পড়ানোর
জন্য আর বাঁদর পেল না ওরা? এই ঠাট্টা শুনেই তো গাঁয়ের লোকেরা নানা কথা রটায়। টুপাই
তো ওর বন্ধু। বন্ধুকে আবার কেউ বিয়ে করে নাকি? গত বছর ঝুমিদি’র বিয়ে হল বটজোড়াতে। জামাইয়ের
কেমন বেশ ভরিক্কি চেহারা। তেমন না হলে বর বলে মানতে ইচ্ছে হয় কারো?
‘মা তোকে গিন্নীমা
কেন বলে বেশ বুঝতে পারছি,’ চোখে কৌতুকের হাসি নিয়ে বলল টুপাই।
শীর্ণ হাতে গল্পের বোঝা টানা সহজ নয় ওর পক্ষে। তবুও মজার কথায় হাসি আসে বৈকি।
‘তা মণিমাসি
যা বলে বলুক, আমার কিন্তু খুব শিগ্গিরই বইগুলো ফেরত চাই বলে দিলাম।’
‘এই যে বললি
তোর পড়ার সময় নেই?’
‘খালি তুই বুঝি
পড়বি আর আমি গো-মুখ্যু হয়ে থাকবো চিরকাল? সে হবে না। পড়া হয়ে গেলেই এখানে এসে দিয়ে
যাবি,’ মনখুশি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। চোখে তার অদ্ভুত কাতরতা। এত কষ্ট করে আগল তুলে রাখা
কাঠিন্য ভেসে গেল বুঝি। টুপাইয়ের হাত টেনে ধরে সে বলে উঠল, ‘আমার দিব্যি। বল, তুই এসে
বইগুলো ফেরত দিবি।’
ঢোঁক গিলতে
কষ্ট হল টুপাইয়ের। প্রশ্ন যে বড়ই কঠিন। এবারের পুজোয়, সকলে ঠাকুরের কাছে এই কথাটাই
জানতে চেয়েছে বারবার। অষ্টমীর সারা রাত মা, দিদিমা, মামিরা মূর্তির পা ছুঁয়ে বসে থেকে
আকুল মনে প্রার্থনা করেছে, টুপাই যেন আবার আসতে পারে সামনের বার। দশমীর বিসর্জনে বাবার
চোখেও জল এসেছিল কি? বিজয়া করতে গিয়ে দাদামশায়ের বুকে জড়িয়ে ধরা বা দিদিমার আদর সবই
যেন অনেক-অনেক স্পেশাল টুপাইয়ের কাছে। কি যায় আসে, রক্ত কণিকাগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া
করে আর যদি ওকে এখানে আসতে না দেয়। এত আনন্দ, হৈ- হুল্লোড়, ভালোবাসা সব সে একান্ত নিজের
করে রেখেছে। সেটা কাড়বে, সেই সাধ্য কারোর নেই।
‘সামনের বছর
পুজোতে আমি অন্য কোথাও ঘুরতে যাব। এখানে আসা হবে না হয়তো। গেল তোর বইগুলো,’ রিক্সায়
ব্যাগ রেখে বলল টুপাই। ওর বাবা আর মা একটা রিক্সাতে উঠে পড়েছে।
টুপাই পরেরটাতে একলাই যাবে। মনখুশির দিকে ফিরে দেখল ওর মুখের আলো হঠাৎ দপ্ করে নিভে
গেছে। বেচারি মেয়েটা বই না পেলে খুব দুঃখ পাবে মনে হয়। টুপাই তড়িঘড়ি
ওকে খুশি করতে বলল, ‘তুই একদম চিন্তা করিস না। মেজমামা এর মধ্যে কলকাতা গেলে, আমি ঠিক
মনে করে ফেরত পাঠিয়ে দেব।’
মনখুশির মুখে
হাসি ফুটল না তাতে। টুপাইয়ের ঘুরতে যাওয়ার মানে সে জানে। বিদায় কালে মনিমাসির চোখের
জল ফেলা সে শুনেছে। চৌচির হয়ে গেছে ওর বুকের ভিতরটা। টুপাই তাকে এমন ফাঁকি দেবে সে
কি কোনোদিন ভেবেছিল? বকুলগঞ্জের মনখুশির খুব ইচ্ছে করছিল ঠাকুর দালানে গিয়ে আছড়ে পড়ে,
দিদিমার মতন। কিন্তু তাহলে টুপাই জীতে যাবে যে। বলবে, মনখুশিটা এমন ভীতু, যাওয়ার বেলা
সামনে পর্যন্ত এলো না। কোমরে আঁচল গুঁজে চলে এসেছে তাই ঠোঁট কামড়ে। দুকূল ভাঙ্গা ঝড়
ঠেকিয়ে রেখে গল্পের নকশীকাঁথা বুনেছে এতক্ষণ। কিন্তু আর বোধহয় সেই স্রোতে বাঁধ দেওয়া
গেল না। গেঁয়ো মেয়ের গ্রাম্য বাঁধন ভেসে গেল উজানের টানে। লোকলজ্জার ভয় সাঁঝবাতির শিখার
মতন নিভিয়ে সে আছড়ে পড়ল প্রিয় বন্ধুর বুকে। অভিমানে তার প্রশ্ন বুঁজে যায়, ‘পুজো ছাড়া
এমনি বুঝি আসতে নেই এখানে?’
উত্তর কোথায়
টুপাইয়ের কাছে। তার চারপাশের জগতটা আজকাল সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতনই স্থির। আঁকাবাঁকা
নদীর ওপরে ধুলোময় কাল্ভার্ট পেরিয়ে ওর রিক্সা ধীর গতিতে এগিয়ে যায় স্টেশনের দিকে।
মনখুশির দেওয়া বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখে হাসি ফুটে ওঠে টুপাইয়ের মুখে। মৈত্রেয়ী দেবীর
‘ন হন্যতে’ বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখা ছবিটা আর নেই। তার জায়গায়, সাদা টুকরো কাগজে সুন্দর,
গোটা-গোটা হরফে লেখা রয়েছে একটা কবিতা। বকুলগঞ্জের দিগন্তে তখন চাঁদের আনাগোনা। পাখিদের
বুকে ঘরে ফেরার গান। ঝরা শিউলি, পেঁজা মেঘ আর কলাবউয়ের স্মৃতি পেরিয়ে দুই কিশোর মনে
অধীর জিজ্ঞাসা, পূজাবার্ষিকীর পরবর্তী সংখ্যায় ওদের নিয়ে কোনো গল্প থাকবে কি?
যেদিন আসবি আবার, কাশফুলের ভোরে,
শিউলির আলো ছায়ায়, আলসে পথ ধরে,
রোদে পিঠ ছাদে আর আকাশ জুড়ে ছবি,
যেতে না দেই যদি, তবে আবার বন্ধু হবি?
খুব সুন্দর গল্প
উত্তরমুছুনThank you :)
মুছুন