রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২১

খাদ্য বিভ্রাট


 রুই মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল আর তার সাথে গরম-গরম ভাত। ব্যস, আর কি চাই। হ্যাঁ, দুটো ভাজাভুজি হলেও মন্দ হয়না। যেমন ধরা যাক খান দুই কুমড়ো ফুল ভাজা, মাঝারি আকারের বেগুনি এবং ফুলকপির বড়া। সপ্তমী পুজোর সাত্ত্বিক আহার যাকে বলে। সশব্দে ঢেঁকুর তুলে আসন ছেড়ে উঠলুম। ভালো-মন্দ খাওয়ার পর অধিক নড়াচড়া স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর, তমুক বাবা বলেছেন। হুঁ হুঁ, আমি ওনার উপদেশ অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলি। বয়স তো কম হল না। বেশি খাটুনিতে কলকব্জা রাতারাতি বিকল হয়ে পড়ে। তাই ভুঁড়ির দুপাশে বালিশের ঠেকো দিয়ে আমি আরাম করে দাঁতে কাঠি দিলুম। কিন্তু কপালে সুখ সইল না। করোনাসুরের দৌরাত্ম্যে বারান্দা থেকেই এবারে পূজা-পরিক্রমা সারতে হচ্ছে। তাই, গিন্নির মেজাজ সেই মহালয়া থেকেই বেজায় গরম। আমায় আয়েশ করতে দেখেই খিঁচিয়ে উঠলেন- ছোটলোকের মতন দাঁত খুঁটছ কেন?।

-কাঁটা ঢুকলে সবাই খোঁটে। এ তো আর নাক নয়।

-কচ্ছপের মতন এত ঝেড়ে, বেছে খাও। তাতেও কাঁটা ঢোকে?

বুঝলুম, তিনি আমায় সহজে ছাড়বেন না। সকাল থেকে রাঁধাবাড়া করানোর বদলা নিতে হবে বৈকি। এখন থেকেই খোঁচা মেরে বৈকালিক অশান্তির মেঘ জড় করার চেষ্টা করছেন। আমি জেনেশুনে তো আর সেই উদ্দেশ্য সফল হতে দিতে পারি না। খোঁচাখুঁচি বন্ধ রেখে বললুম- ধীরেসুস্থে, বুঝেশুনে খাওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। আমার সাথে একবার যা হয়েছিল না....

গিন্নি দেখলুম গাল ফুলিয়ে উদাস চোখে দেওয়ালের টিকটিকি দেখছেন। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে আমি শুরু করলাম।

-সে অনেককাল আগের কথা। তখন রমরমিয়ে চলছে আমার হস্টেল জীবন…

পুজোর ছুটি যত এগিয়ে আসছে, মেসে খাবারের মান পাল্লা দিয়ে নিম্নগামী হচ্ছে। পরিস্থিতি চরমে পৌঁছল মহালয়ার দু’সপ্তাহ আগে।  সিভিলের ‘ঘুঁটে’ হল মেস ম্যানেজার। একেই সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা সবেতেই অতিশয় কৃপণ, তার ওপরে মেস বিল কমানোর দায় পড়লো তার ঘাড়ে। ফলস্বরূপ, দু’বেলার আহারই তখন আবাসিকদের কাছে রীতিমত বিভীষিকা। দিনের পর দিন মেসের অখাদ্য কোনোমতে পেটে ঢুকিয়ে ক্রমাগত শীর্ণ হওয়া ছাড়া উপায় কি? জলবৎ তরলং ডাল আর মোটা চালের ভাত ছাড়া কিছুই বেরত না হেঁসেল থেকেমাছ, মাংস তখন অলীক স্বপ্ন। কোনোদিন ভাগ্য নিতান্তই সুপ্রসন্ন হলে ডিমের ঝোল জুটতযদিও আকার বিচার করলে ডিমগুলো মুরগির না চড়াইয়ের তা নিয়ে সন্দেহর যথেষ্ট অবকাশ ছিলনিরুপায় হয়ে, হাতখরচা বাঁচানো সীমিত সঞ্চয় ভাঙ্গিয়ে, মাঝেসাঝে কলেজমোড়ের হোটেলে মুখের স্বাদ বদলাতে যেতুম।

তেমনই এক নিরামিষ দুপুরে, বাড়ি আসার আগেরদিন, মেসে লাঞ্চ সারছিলুম। মনে-মনে ‘ঘুঁটে’র চোদ্দগুষ্ঠির নামে শাপ-শাপান্ত চলছে। হঠাৎ, মুখে মাছের কাঁটা পড়তে বেশ অবাক হলুম। পাতে মাছ নেই, অথচ মুখে মাছের কাঁটা? এ তো দারুণ চমক। পরম যত্নে সেটাকে দাঁত দিয়ে ছাতু করার চেষ্টার মধ্যেই টেবিলে বাকিদের বললুম- আজকে দেখছি মাছের কাঁটা দিয়ে ডাল করেছে।

নিমেষের মধ্যে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। মা দুর্গার আশীর্বাদে শুধু আমি ভালো খাবার পাবো, আর বাকিরা বঞ্চিত থাকব, সেটা একেবারেই অনুচিত। আমার পাশের রুমের সুমিত, টেবিলের মাঝখানে রাখা ডালের বড় গামলায় মিনিট দুয়েক হাতা দিয়ে খুব ভালো করে ঘেঁটে কনফার্ম করলো, মাছের শরীরের কোনো প্রত্যঙ্গই সেখানে নেই। বড়ই আশ্চর্য ঘটনা। গত সপ্তাহেই আমার ভাতে বড়সড় বড়্‌শি পড়েছিল। কামড়াতে গিয়ে প্রায় দাঁত ভাঙ্গার জোগাড় হয় আর কি। আমি জিভ দিয়ে নেড়েচেড়ে ঠাহর করে দেখলুম, এটা তেমন ধাতব কিছু নয়। কিন্তু সহজে বাগেও আনা যাচ্ছে না।

তোর মাথাটা গেছে। এই দুর্ভিক্ষের বাজারে মাছের স্বপ্ন দেখছিস কোথা থেকে? -বিপিন ওর স্বভাবসিদ্ধ তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলল।

অকারণে কথা শুনলে তো চুপ করে থাকা যায় না। প্রমাণ দাখিল করতেই হবে। ওদিকে, দাঁতের অনেক ব্যায়ামের পরেও তথাকথিত মাছের কাঁটা তার আকার অবিকৃত রেখেছে বুঝতে পারছি। ততক্ষণে মোটামুটি মায়া কাটিয়ে এনেছিলুম ওটার ওপর থেকে। ভেবেছিলুম গোটাই গিলে ফেলব। কিন্তু বিপিনের চ্যালেঞ্জের পর, মুখের থেকে মাছের কাঁটা বের করে থালার পাশে রেখে বললুম- তোরাই দেখে বল।

সুমিত ওয়াক শব্দ করে টেবিল থেকে উঠে গেল। পিছনেই ছিল হাত ধোয়ার বেসিন। সেখানে হড়হড় করে ঢেলে দিল যেটুকু খাবার ওর পেটে ছিল। বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ। বিপিন খাওয়া ছেড়ে দুচোখ বন্ধ করে বসে আছেযেই জিনিসটা নিয়ে দের এত বিতৃষ্ণা, আমি তাকে আঙ্গুলে তুলে ভালো করে দেখলাম। নাহ, ওটা মাছের কাঁটা বা বড়শির টুকরো নয়। ওটা পায়ের বুড় আঙ্গুল থেকে সুন্দর করে কাটা বেশ মোটাসোটা নখ। সম্ভবত মেসের রাঁধুনি মামু আরও সুস্বাদু ডাল বানানোর জন্যে কোনো গোপন রেসিপি ব্যবহার করেছে। নখটা এখনও আমার সংগ্রহে আছে চাইলে দেখাতে পারি।

-খবর্দার, একদম না। ছ্যাঃ এত নোংরা ব্যাপার, গিন্নি মুখ বিকৃত করে বললেন।

-কিন্তু সেই নখ আমাকে আরও বড় বিপদের থেকে রক্ষা করেছিল। আমি রহস্য রেখে বললুম।

-সে কিভাবে?

-সে’দিন বিকেলে পেট আনচান করছিল বলে রাতে কিছু খাব না ঠিক করলুম। অথচ রাতে কিনা আয়োজন হল চিলি চিকেন আর ফ্রাইড রাইসের। ছুটির আগে ‘ঘুঁটে’ সবাইকে চমকে দিয়ে নাম কিনবে ভেবেছে। আমি পেট চেপে ঘরে শুয়ে রয়েছি আর সকলে মহানন্দে ভুঁড়ি ভোজ করছে। ঘুঁটে খেতে বসল একেবারে শেষ ব্যাচে। আমাদের মেসে চিলি চিকেনেও ঝোল থাকতো। ‘ঘুঁটে’, রাঁধুনি মামুর কাছে ঝোলে ডোবা একটা সন্দেহজনক তেজপাতার খবর নিল। ওর তৎপরতায় অবিলম্বেই সকল সন্দেহের নিরসন হয়ে গেল। ঝোল থেকে যেটাকে বের করা হল সেটা একটা আস্ত নেংটি ইঁদুর। মরে কাঠ হয়ে গেছে। ওইটুকু উঁচিয়ে থাকা লেজ দেখে তেজপাতার ডাঁটি মনে হয়েছিল বাইরে থেকে।

-তারপর? গিন্নির ভুরূ আকাশে উঠল।

-তারপরে আর কি। খবর শুনে গোটা হস্টেল হাসপাতালে ছুটল। আমি ততক্ষণে বেশ সুস্থ বোধ করছি। দু’হাত জড় করে নখ দেবতাকে প্রণাম করে ব্যাগ গোছানো আরম্ভ করলুম। বাকি সবাই সে’বারের পুজোতে প্লেগ, কলেরার ভয়ে ঘরবন্দি হয়ে ছিল। এরপরেও দেখেশুনে না খেলে চলে, কি বল? 

1 টি মন্তব্য:

আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান