কন্ট্রোল সিস্টেমের উত্তর লিখতে বেশ চাপ খাচ্ছিলাম। প্রশ্নগুলো সব ঘোর-প্যাঁচওয়ালা। কোনো কিছুরই সোজাসাপটা জবাব নেই। সামনের বেঞ্চের অচিন ঘাড় গুঁজে লিখেই যাচ্ছে পাতার পর পাতা। প্রথম দেড়-ঘণ্টাতেই দু’বার এক্সট্রা পেজ নিয়েছে। কি এত সাহিত্য চর্চা করছে কে জানে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলাম। জানা প্রশ্নগুলোর, খুবই সংখ্যালঘু তারা, উত্তর লেখা হয়ে গেছে সেই কখন। শুধু এ’কটাতে পাশ নম্বর উঠবে কিনা সন্দেহ। এ’বারে গাঁজাখুরি গল্পেই পাতা ভরাতে হবে। নইলে ফাঁকা খাতা দেখে পরীক্ষক শুধু পরিচ্ছন্নতার জন্যে এক-দুই নম্বর দেবেন।
বুদ্ধির শিকড়ে ধোঁয়া, থুড়ি
হাওয়া দেওয়ার জন্যে ভাবলাম টয়লেট থেকে ঘুরে আসি। করিডোর থেকে সামান্য এগিয়ে, ডান হাতে ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টে
রয়েছে মেন্স রুম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম
আবহাওয়া
বেশ করুণ। মেকানিক্যালের
শুভায়ু,
একটা বন্ধ বুথের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত দরজায় টোকা মারছে আর কাতর
গলায় অনুরোধ করছে, ‘একবার খোল না প্লিজ! এভাবে দেরি
করালে পাশ করবো না মাইরি’।
‘আহারে, বেচারার বোধহয়
খুব জোরে পেয়েছে’, আমার
করুণা হল শুভায়ুর ওপরে। কলেজে
আসার সময় পথে দেখা হয়েছিল ওর সাথে। কি সুন্দর হাসিখুশী ছিল
ছেলেটা।
এখন একেবারে বিধ্বস্ত।
অসময়ে আসা তাগাদা মানুষের ওপরে
ঝড় বইয়ে দেয়।
তার ওপরে যদি সেটা পরীক্ষা চলাকালীন হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। এই
ব্যাপারে আমার থেকে
বেশি ভালো জ্ঞান আর কারই বা থাকতে
পারে।
উচ্চ-মাধ্যমিকে, ফিজিক্স
সেকেন্ড-পেপার পরীক্ষা মনে আছে? এ.কে.ঘোষ মেমোরিয়াল স্কুলে আধ ঘণ্টা ধরে হন্যে হয়ে টয়লেট খুঁজেছিলাম। প্রশ্নপত্র থেকে যে
সকলের একসাথে ফুড-পয়েজনিং হতে পারে তা ধারণার বাইরে ছিল। আমি অভাগার মতন যেদিকেই গেলাম,
খালি বন্ধ দরজা পেলাম। উফ্, সেই রুদ্ধশ্বাস
আধ ঘণ্টায় আরও কত দুর্ঘটনাই না ঘটতে
পারত।
এতদিন পরেও আবার শিউরে উঠলাম। কিছু-কিছু
অভিজ্ঞতা আধ ঘণ্টায় মানুষের বয়স কয়েক বছর বাড়িয়ে দেয়।
‘শুভায়ু,
তুই পাশেরটাতে যা না’, আমি ওকে
পরামর্শ
দিলাম। বিপদ কালে বুদ্ধিনাশ
হয়েছে নাকি ছেলেটার? এই বিশেষ
বুথের ওপরেই ওর
এমন
অমোঘ আকর্ষণ কেন?
পাশেরটাও
চলনসই পরিষ্কার। চোখ বন্ধ রেখে কাজ সেরে আসা
যেতেই পারে।
‘না
রে হতভাগা।
আমার
ফ্লুয়িড ডায়নামিক্সের বই এর
ভিতরে রাখা আছে। ভেবেছিলাম, মাঝখানে এসে
চোখ বুলিয়ে নেব।
সূত্রগুলো
কিছুতেই মনে থাকে না’,
শুভায়ু উত্তেজিত হয়ে
বলল আমাকে, ‘কোন্
পেটের রুগী
কখন থেকে বসে আছে। দরজা খুলছে না, সাড়াও
দিচ্ছে না’।
‘আঃ, এই ব্যাপার’,
আমার মাথায় লাইট বাল্ব জ্বলল এতক্ষণে। বুঝলাম, কেন এক ঘণ্টার পর থেকেই ছেলেপিলেরা বাইরে যাওয়ার আশায় হাত তুলে বসে আছে। সকলেই
বেশ সেয়ানা তো!
‘ভাই,
কে আছিস? জলদি
বেরিয়ে আয়।
অথবা,
পারলে
শুভায়ুর বইটা দরজার তলায়
দিয়ে দে’,
আমি নরম গলায় বললাম,
‘বন্ধুর বিপদের সময়ে
এগিয়ে আসবি না?’
‘উহু’,
দরজার ওপাশ থেকে চাপা আপত্তি এলো। আরও
নেগোসিয়েশন চালাতে হবে। কঠিন খদ্দের।
‘তবেরে
শালা, খুলবিনা! ইয়ার্কি
পেয়েছিস?’,
শুভায়ু সুক্ষ আলাপচারিতার ধার ধারে না। গলার
সপ্তম সুর শুনে বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটা অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছে।
আমি বাধা দেওয়ার আগেই,
সে তার বড়সড় শরীর নিয়ে বুথের দরজায় মারল
জব্বর ধাক্কা। সরকারী কলেজের ততোধিক
সরকারী দরজা।
বেচারিরা অকারনে উটকো
ঝামেলা সহ্য করবে কেন? দরজার দুই পাল্লাই এক সাথে কর্মবিরতিতে চলে গেল।
আমরা
বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, ইলেক্ট্রিক্যালের
প্রফেসর কার্ত্তিকবাবু,
একহাতে প্যান্টুলুন এবং
আরেক হাতে ভাঙ্গা দরজার ভার সামলে কোনোমতে
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
পরিস্থিতি ভয়ানক দেখে কাপুরুষ শুভায়ু তৎক্ষণাৎ পিঠটান
দিল।
আমি আবার এ’ভাবে
কাউকে
বিপদের মুখে ফেলে রেখে যেতে পারিনা। কাছে যাওয়া
ঠিক হবে কিনা ভেবে
ও’খানেই
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইলাম। কার্ত্তিকবাবু দৃশ্যতই রীতিমত ঝামেলায়
পড়েছেন।
ওই নটরাজের
ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে কোনটার অগ্রাধিকার বেশি
তার হিসেব কষে যাচ্ছেন। দরজা ধরলে পাজামার
মায়া ত্যাগ করতে হবে। অন্যথা,
ভারী পাল্লা দুটোকে কাঁধে নিয়েই বাকি কাজ
সম্পন্ন করতে হবে।
আমি ওনার সাহায্যার্থে দু’পা এগিয়েও মাঝপথে মনোবল হারিয়ে ফেললাম। সারা
জীবন ভয়ানক দুঃস্বপ্নের
বোঝা টানার সাহস খুব কম লোকেরই থাকে।
‘চিন্তা
করবেন না, আমি এখুনি হেল্প ডাকছি’,
স্যারের
সাথে দৃষ্টি বিনিময় এড়িয়ে, অকুস্থল
ত্যাগ করলাম। তারপরে সোজা ঢুকে পড়লাম
নিজের পরীক্ষার হলে। ভবিষ্যতে আমায় কার্ত্তিকবাবুর
ক্লাসে
প্রক্সি মারতে হবে। ওনার
অমূল্য জ্ঞান-ভাণ্ডারের দরজা, আজ থেকে আমার জন্যে যে চিরতরে বন্ধ তাতে কোনো দ্বিমতের
অবকাশ নেই। অবশ্য সে’সবের
আগে ওনাকে ওই দরজার তলা থেকে সসম্মানে বের হতে হবে।
এই দুর্ঘটনার পরে আশা করি উনি বুঝবেন, কোনো অসহায় হবু ইঞ্জিয়ারকে
টুকলিতে বাধা দিলে, তার
ফল কখনও মঙ্গলময় হতে পারে না। বিশ্বকর্মা আছেন, তিনি সব দেখছেন।।
দারুণ সরস লেখা। খুব হাসলাম 😍
উত্তরমুছুন