বালিশে আধশোয়া হয়ে পিকলু ঠাকুমার কাছে অসুর নিধনের গল্প শুনছিল। ঠিক যখন দুর্গা ত্রিশূল ছুঁড়বে ভাবছে, তখনই হট্টগোলটা শুরু হল । ঠাকুমা বিরক্তিতে দরজার দিকে তাকাতেই পিকলু ঝুপ্ করে খাট থেকে লাফিয়ে সোজা বারান্দায় চলে এল। দেখল, বাড়ির সকলেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। রাত সবে দশটা হলেও, ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাক মাঝরাতের আমেজ এনেছে।
‘কি অইলডা কি?
কে মরসে?’ জ্যাঠামশাই আফিমের ঘোরে ঢুলতে-ঢুলতে শুধোলেন। গলায় পাকা ঘুম ভাঙ্গার বিরক্তি।
‘অ রোথিন, আলোডা পিটপিটায় ক্যান?’
‘দাদা, টিউবের
চোখ হেই কবেই গ্যাসে তুমি তো জানোই’, বাবা ভুরু কুঁচকে চশমার কাঁচ মুছতে-মুছতে বললেন।
‘কই গো! টর্চখান ফ্যালো একবার।’
শোনা মাত্রই
মা আর জ্যাঠাইমা খুট্খুট্ করে পুঁচকে দু’খানা টর্চ উঠোনের দিকে তাক করল। পিট্পিট্
করা টিউব আর টর্চের সম্মিলিত আলোয় বোঝা গেলো বাড়ির পুরনো লোক ভজুকাকা, মাটিতে চিৎপাত
হয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে। ওদের দেখতে পেয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলেও সেটা নিছক ব্যর্থ হামাগুড়ি
হয়ে দাঁড়ালো। মুখে কিম্ভূত শব্দে কিছু বলার চেষ্টা করছে, যেটা পিকলুরা
কেউই বুঝে উঠতে পারছে না।
‘ভজুরে ভূতে
পাইসে নাকি?’ জ্যাঠাইমা কাঁপা গলায় বললেন। ‘ঠাকুরপো, হেই থেইক্যা কইতাসি নিম গাসটা
কাইট্যা ফালাও। শাগচুন্নি বাসা করে ওতে।’
‘তুমি রাইত-বিরেতে
ত্যানাদের কথা কেন্ কও বৌদি?’, ছোট্কা ফোঁস করে উঠল। ছোটকা অকৃতদার এবং খুবই ভীতু
প্রকৃতির মানুষ, দিনে রাতে কখনই অশরীরীদের নিয়ে আলোচনা করতে চান না।
‘ছোট, চন্দন
কই?‘ বাবা ছোট্কাকে জিজ্ঞাসা করলেন। চন্দন পিকলুর জ্যাঠতুত দাদা,
দিল্লীতে গাছ-গাছড়া নিয়ে রিসার্চ করে। আজকেই বাড়ি এসেছে পুজোর ছুটিতে।
‘ঘরেই আসে,
চাদর চাইপ্যা ঘুমাইতাসে।’
‘ভজুরে দাওয়া
থেইক্যা না তুইলা এইখানে কি মিটিং করতাছোস?’ ঠাকুমা রেডিওটা বগলদাবা করে বেরিয়ে এসেছেন
এতক্ষণে। আগামীকাল মহালয়া, উনি কিছুতেই ওটা আজকে হাতছাড়া করবেন না।
‘ছোট, ভজুর
লগে যাতো। আমি রাইতের বেলায় ভালো চোখে দেখিনা,’ বাবা ক্রমাগত চশমা ঘসে নিমতলায় যাওয়া
এড়ালেন। জ্যাঠামশাইয়ের ভরসা নেই, তিনি থামে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছেন আর থেকে-থেকে ‘কি
অইলডা কি?’ বলে হেঁকে উঠছেন।
‘ভাইপো, আইসবা
নাকি?’ ছোটকা নিরুপায় হয়ে পিকলুকে সাথী করল। সবাই জানে এ বাড়িতে
দাদাভাইয়ের পরে ওর সাহসই সবথেকে ওপরের দিকে।
‘রমেন আজকাল
ভজুকেও আফিম দিচ্ছে নাকি?’ পাশের বাড়ির রায় জেঠুর গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
‘বাঙ্গালের স্বভাব যত।’
পিকলুদের বাড়ির হইচইতে কাছেপিঠের অনেকের ঘরেই
আলো জ্বলে উঠেছে। রায় জেঠু পুলিশে কাজ করতেন, খুচখাচ কিছু হলেই লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন
এখনও। দুই জেঠুতে একসময় গলায় গলায় ভাব ছিল। গাভাস্কার না পাতৌদি, কে বেশি বড় খেলোয়াড়,
তাই নিয়ে ঝগড়া করে গত কয়েক বছর ওদের কথাবার্তা বন্ধ। দুই বাড়ির বাকিদের মধ্যে যদিও
খুব ভাব। রায় জেঠুর মেয়ে ফুটুদি, ছোড়দির বেস্ট ফ্রেন্ড। পিকলুদের
ফুটুদি খুব ভালোবাসে। ঠাকুমা আর ওর জন্যে আলাদা করে কুলের আচার বানিয়ে দেয়। ছোড়দি ওকে
‘বৌদি’ বলে ডাকলে খুব রেগে যায় কিন্তু আবার লজ্জায় লাল হয়ে দুটো কুল বেশীও দেয়।
‘পেএএএত্ন্ন্নি…’
ভজুকাকার কাছাকাছি
যাওয়ার পরে ওর কথা কিছুটা হলেও বুঝতে পারলো পিকলু। ও পাঁচিলের পাশের নিমগাছটার দিকে
আঙ্গুল তুলে অদ্ভুত শব্দ করে যাচ্ছে। দাঁতকপাটি লেগেছে মনে হয়।
‘খাইসে! ডাকাইত!’
ছোট্কা কাউকে
দেখে ভির্মি খেতে গিয়েও তুলসি মণ্ডপ ধরে নিজেকে সামলাল। পিকলু তো
আনন্দে আত্মহারা, ডাকাত আর পেত্নী একসাথে হানা দিয়েছে ওদের বাড়িতে। জানলে ইস্কুলের
সব্বাই হিংসে করবে ওকে। এদিকে ডাকাত শুনে রায় জেঠুও একলাফে দেওয়াল টপকে এপারে এসে হাজির।
ওঁর হাতে বিরাট পাঁচ সেলের পুলিশি টর্চ আর পাকা বেতের লাঠি। এসেই মণ্ডপের পিছনে হাসনুহানার
ঝোপে চালিয়ে দিলেন সপাং সপাং করে। চোর ডাকাতে ওনার ভয়ানক অ্যালার্জি। তবে এলেম আছে
বলতে হবে। ঝোপের পিছন থেকে ঝুল মাখা একজনকে ঘাড় ধরে বের করে এনে অনায়াসে কয়েক ঘা বসিয়ে
দিলেন। মারের চোটে ছেলেটা ককিয়ে উঠতেই সবাই চমকে গেলো।
‘একি? চাঁদু
তুই?’
রায় জেঠু অবাক
হয়ে গেলেন। তাঁর থাবায় আটকা পড়েছে পিকলুর দাদাভাই চন্দন।
‘ছোট যে কইল
তুই ঘরে ঘুমাইতাছিস?’ বাবা এতক্ষণে সাহস পেয়ে নেমে এলেন আঙ্গিনাতে।
‘ও’টা কোলবালিশ,’
দাদাভাই পায়ে হাত বুলাতে-বুলাতে বলল। লাঠির ঘা খেয়েছে বেচারা ওখানে।
‘আমার বাগানের
গোলাপ চুরি করেছিস ব্যাটাচ্ছেলে?’ রায় জেঠু বাঘের মতন গর্জালেন। পিকলু
দেখল দাদাভাইয়ের হাতে একটা মাঝারি মাপের গোলাপ ফুল। রায় জেঠুর খুব সাধের গোলাপের
বাগান আছে। সারাদিন পাহারা দেন। ফুল দেখেই চিনতে পেরেছেন।
দাদাভাই আমসি
মুখে কিছু বলবে ভাবছিল কিন্তু একটা ‘মড়াৎ’ শব্দে সকলেই চমকে নিম গাছের দিকে তাকাল।
উঠোনের টিউবটাও তক্ষুনি পাকাপাকি জ্বলে ওঠাতে পেত্নীর রহস্যেও আলোকপাত হল।
‘তুমি?’ ডাল
ভেঙ্গে ধরাশায়ী ফুটুদিকে দেখে পিকলু তো থ।
দাদাভাই তাড়াতাড়ি
ছুটে গিয়ে ঝুল পাতা মাখা ফুটুদিকে হাত ধরে তুলে দাঁড় করাল। তারপরে মৃদুস্বরে ওর হয়ে
সাফাই দিলো, ‘বটানি রিসার্চের কাজে লাগবে বলে ফুটু ফুলটা দিতে এসেছিল আমাকে। ভজুকাকাকে
ভূত ভেবে ভয়ে গাছে উঠেছে।’
‘থাউক, শাগ
দিয়া আর মাছ ঢাকোনের কাম নাই। আমাগো চোখে কি ন্যাবা?’ ঠাকুমা দাদাভাইকে ধাতানি দিয়ে
মা, জ্যাঠাইমার উদ্দেশ্যে বললেন। ‘কাল শুভদিন আসে, আশীর্বাদটা সাইর্যা ফেলাও। ঘটির
মাইয়া অইল তো কি অইসে, আচারটা বাইর্যা বানায়।’
‘কি পাগলি দ্যাখেন।
রাতের বেলায় কেউ গাসে চড়ে? অমন চাঁদপনা মুখ, কাইট্যা, ছইড়্যা যায় নাই তো?’ জ্যাঠাইমা
ছুটে গেলো নিমতলায়, ফুটুদির কাছে। সঙ্গে মা আর ছোড়দি। ছোড়দি মিচকি
হেসে দাদাভাইয়ের হাতে দিলো রাম চিমটি।
এইসব কোলাহলের
ভ্রান্তিতে আরেক কাণ্ড হল। প্রতিবেশী চক্কত্তিমশাই, দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গেছে ভেবে, ছাদে
এসে তারস্বরে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমাযেতি শব্দিতা’ মন্ত্রজ্বপ শুরু করে দিলেন।
রাত্তিরবেলার হইচই আর অকাল বোধনের আড়ম্বরে পিকলুও ততক্ষণে আনন্দে আত্মহারা। পুজোর ছুটিটা
দারুণ কাটবে এ’বছর।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান