‘কি র্যা? কোথায় তেরা গ্লেসিয়ার?’ বাবা বাংলা হিন্দির অদ্ভুত মিশ্রণে জিজ্ঞাসা করলো ঘোড়াওয়ালাকে। বাবার ঘোড়ার কয়েক হাত পরেই হেলে-দুলে চলছে আমারটা। চাচা আর ভাতিজা, দু’জনে আমাদের পাশে লাগাম ধরে হাঁটছে। পাহাড়ের গায়ে কোথাও বরফের চিহ্ন মাত্র দেখা যাচ্ছে না। গ্লেসিয়ার এখানে কিভাবে আবির্ভাব হবে? বাবা’কে দেখলাম, সাথের নীল ছোট হাতব্যাগ বুকের কাছে চেপে ধরেছে। ওটাতে ক্যাশ টাকা তোলা থাকে, প্রতিদিনের খরচার জন্য। কলকাতা হলে, নভিস পকেটমাররাই চোখ বন্ধ করে ফাঁকা করে দিত সেটা এতদিনে। তবে বাবা’র বিশ্বাস, দেশের বাকি লোকেরা এখনও অতটা বখে যায়নি। সুতরাং, ঘুরতে গেলে নীল ব্যাগ বাবার সর্বক্ষণের সঙ্গী।
‘হেই থোরা অউর
আগে,’ চাচা হাতের ইশারায় আরও ওপরের দিকে দেখাল। তারপরে, আমাদের অধৈর্য ভাব কাটাতে দূরের
পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উধার হ্যায় হমারা পোস্ট। উস্পার পাকিস্তানি আর্মি’।
আমি ব্যস্তসমস্ত হয়ে চোখে দূরবীন লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম দেশের সীমানা। আকাশছোঁয়া
পাথুরে পাহাড় ছাড়া কিছুই নজরে এলো না। বস্তুত রুক্ষ শিলাময় মরুভূমিতে আমরা ছাড়া প্রাণের
চিহ্নমাত্র নেই।
‘খুব ভুল হয়ে
গেছে বুঝলি। এদের সাথে না এলেই হত,’ বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে, বিশুদ্ধ বাংলায় বলল। কথাটা যে
আমার মাথায়ও আসেনি তা নয়। এতো আর যেমন তেমন যায়গা নয়। একেবারে কাশ্মীর। যেকোনো মুহূর্তেই
অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গুলমার্গে গন্ডোলা রাইড নিয়ে
কংডুরি স্টেশনে পৌঁছে জেনেছিলাম দ্বিতীয় ধাপের রোপওয়ে যান্ত্রিক গোলযোগে বিকল। বরফ
না পেয়ে আমরা তো খুব হতাশ। তখনই, ঘোড়াওয়ালারা এসে হাজির হয়। কাছেই নাকি গ্লেসিয়ার।
হাজার টাকায় ঘুরিয়ে আনবে। মা কিছুতেই রাজি হল না, তাই আমরাই চলে এলাম। কিন্তু মিনিট
পনেরো হয়ে গেলো, জনশুন্য চড়াই ধরে উদ্দেশ্যহীন ভাবে চলেছি। এদের যদি বদ মতলব থাকে,
তাহলে প্রাণ নিয়েও টানাটানি হতে পারে। পুলিশ বা আর্মির কেউই এখানে নেই বাঁচানোর জন্য।
‘ইধর থা গ্লেসিয়ার,’
দুটো পাহাড়ের মাঝে একটা খাদের কাছে এনে ঘোড়া দাঁড় করাল চাচা।
‘থা হয়ে গেল
ক্যায়সে? শুরুমে তো নহি বোলাথা কি গ্লেসিয়ার থা?’ বাবা খুব ক্ষেপে গেল চাচা’র ওপরে।
খুবই স্বাভাবিক। হিমবাহের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। সোজাসাপটা টুপি পরানো একেই বলে।
‘যল্যলা মে
টুট্ গেয়া,’ চাচা ভাবলেশহীন হয়ে বলল। যল্যলা মানে ভূমিকম্প সেটা ততদিনে শিখে গেছি।
পুজোতে কাশ্মীর ঘুরতে এসে নিত্যদিনের রোমাঞ্চের সাথে কিছু নতুন শব্দের সঙ্গেও পরিচয়
হয়েছে।
ইতিমধ্যে কোত্থেকে
এক বুড়ো চা’ওয়ালা এসে আমাদেরকে দুটো গরম কাশ্মীরি চায়ের মগ ধরিয়ে গেল। দেখতে পেলাম,
একটা বিরাট পাথরের চাঁইয়ের পিছনেই ওঁর উনুন। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই। বুঝলাম, ইনিও
ঘোড়াওয়ালার আত্মীয় কুটুম। ওদের সাথে গ্লেসিয়ার দেখতে এলে চা’ও খেতেই হবে। এই দুর্গম
যায়গায় না বলার আস্পর্ধা দেখানো একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
গরম চা আর মশলা
রুটি নিয়ে আমরা উনুনের পাশে বসলাম। দাদাজি ভাঙ্গা হিন্দিতে সুখ-দুঃখের গল্প করা শুরু
করলো বাবার সাথে। আমি সতর্ক চোখ রাখলাম ঘোড়ার সহিসদের ওপরে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে কিছু
একটা গোলমাল হবেই। দাড়িওয়ালা লোকগুলো এক্ষুনি হয়তো ফিরানের ভিতর থেকে বের করে আনবে
কালাশনিকভ।
তেমন কিছু হল
না। রুটি আর চা’এর দাম চাইলো আড়াইশো টাকা। একেবারে বাটপাড়ি। কিন্তু, বাবা উল্টে পাঁচশো
টাকা দিয়ে দিল। আমি ইঙ্গিতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু বাবা না দেখার ভান করে রইলো। গন্ডোলা
স্টেশনে যখন ফেরত এলাম, মা দুশ্চিন্তায় অস্থির। সুযোগ পেয়ে বাবা’কে চেপে ধরলাম। ‘কেন
তুমি বেশি টাকা দিলে?’
খুব সুন্দর 👌
উত্তরমুছুনThank you
মুছুন