বসন্তবিলাপ, অর্থাৎ আমাদের সূর্য স্যারের বাংলা কোচিং থেকে বেরিয়েই অয়ন আমার হাত টেনে ধরল। বলল, “ওইদিকে দেখ। মোড়ের কাছে ঝিণ্টি দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আজকেই তোকে প্রপোজ করবে।“
ধড়াস করে উঠল
আমার বুক। সত্যি, ঝিণ্টি ঠায় এ’দিকেই চেয়ে রয়েছে। স্যারের সাহিত্যালোচনার
ফাঁকে চোরা দৃষ্টির আদানপ্রদান হচ্ছিল শুভবিজয়ার করমর্দনের পর থেকেই। আমি তখনও মিথিলা-কে
নিয়ে আশাবাদী ছিলাম বলে পত্নীনিষ্ঠতার কাঠিন্য বজায় রাখতাম চেহারায়। তবে এতদিনে মোটামুটি
নিশ্চিত যে সে’কুলে আমার ঠাঁই নাই। তাই আজ বোধহয় ফিক্ করে হেসেও ফেলেছিলাম চাউনির
উত্তরে। তাতেই নির্ঘাত দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেলেছে।
“অন্য পথ দিয়ে
বাড়ি ফিরলে হয় না?” আমি প্রস্তাব দিলাম।
“ছিঃ, বৌদি
তোকে কাপুরুষ ভাববে। মরদের মতন বুক চিতিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়া। ভয় কিসের?”
“আহা, এখনই
বৌদি বলার কী আছে? সবে পরশু বললাম ঝিণ্টি-কে আমার খারাপ লাগে
না আর ওমনি তোর লম্ফঝম্ফ শুরু। মনে নেই, আদৃতা-র বেলায় হুড়োপাড়া করতে গিয়ে কেমন কেলেঙ্কারি
হয়েছিল?”
“বস্, আসল
ব্যাপারটা হল আত্মবিশ্বাস। ওরা সেটাই দেখতে চায়। চোখে চোখ রেখে একবার কথা বলে দেখ,
পুরো দুনিয়া লাট্টু,” অয়ন বলল।
“ফাঁকা কলসির
বাজনা বেশী। পাপিয়া তোকে ভাই পাতায়নি?”
“ওটা মিসহ্যাপ।
সায়েন্সের মেয়েদের সঙ্গে কক্ষনও প্রেম করবি না। আবহাওয়াটাই বিষাক্ত সে’খানে। ঘাড় কাত
করে নোট কপি করে দিতে বলে। কিন্তু দোকলা ফুচকা খাওয়ার প্ল্যান ফাঁদলেই রাখি দিয়ে ইনস্যুরেন্স
করিয়ে রাখে। তারচে’ বাংলা বা ইংরিজি কোচিং ঢের ভালো। ক্লাসে ঢুকলেই মনে হয় বাতাসে বহিছে
প্রেম…”
“অ্যাই, একটা
কথা ছিল। শোন্ এ’দিকে…”
কথায় কথায় কখন
মোড়ের মাথায় চলে এসেছি, খেয়ালই করিনি। থমকালাম ঝিণ্টির তীক্ষ্ণ
ডাক শুনে। অস্বীকার করব না, হঠাৎ ভীষণ ঘাবড়ে পাশের বিশ্বনাথ হার্ডওয়ার্সে সিমেন্টের
বস্তা গুনতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কমলি ছোড়নে ওয়ালি নহি। আবার হাঁক ছাড়ল, “কিরে, শুনতে
পাচ্ছিস না?”
“তোকে ডাকছে
মনে হয়,” আমি অয়নের জামা টেনে বললাম। “তোর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।“
“তোর বউ আমায়
ডাকবে কেন হতভাগা?” অয়ন খিঁচিয়ে উঠল। “মেয়েটা একটু লক্ষ্মী ট্যারা। তাই ভুল বুঝছিস।
যা, দুগ্গা দুগ্গা বলে এগিয়ে যা। “
“হারামজাদা
তোকে কতবার বলেছি ট্রু লাব নিয়ে বাওয়াল দিবি না। আগ বাড়িয়ে বৌদি বৌদি করলে যাবে সব
ভেস্তে আবার। যত অলক্ষুনে ব্যাপার।”
অয়ন-কে গাল
পেড়ে আমি ঝিণ্টির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওর এত কাছাকাছি আগে কোনও
দিন আসিনি। গলা শুকিয়ে গেল তাই। তবে টের পেলাম, অয়নের চোখে ন্যাবা আছে। মেয়েটা মোটেই
লক্ষ্মী ট্যারা নয়। বরং এমন ডাগর আঁখিতে আমার পায়ের তলায় ভূমিকম্প হল। না না ভুল বললাম।
আর্থ-কোয়েক হয়েছিল তিয়াসার বেলায়। আর কান দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়েছিল সৌমিতার হাসি দেখে।
গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এ’বারেরটা একেবারে আলাদা অনুভূতি। সাইকেল, অটো, রিকশার হর্নকেও
গিটারের ঝঙ্কার মনে হচ্ছে। দু’সপ্তাহ পরে উচ্চমাধ্যমিক শুরু। নিকুচি করেছে তার। ঝিণ্টি তুই একবার বল, নেই তোর নেই, কেউ নেই…
“হাঁ করে দাঁড়িয়ে
আছিস কেন?” কর্কশ গলায় বলল সে। “স্যার-কে গিফ্ট দেব বলে আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলেছি।
তুই আর অয়ন সেই কবে থেকে ঝোলাচ্ছিস। এখুনি দু’জনে দশ টাকা করে দিয়ে দে ডিম্পি-কে।“
আশাভঙ্গের ঝনঝন
আওয়াজ চেপে ঢোঁক গিলে বললাম, “ডিম্পি কে?”
“সেকিরে! তুই
আমার নামও জানিস না?” ঝিণ্টির কাঁধের পিছন থেকে আরেকটা চাঁদপনা
মুখ অক্ষিপুট পিটপিটিয়ে জানতে চাইল।
এক লাফে অয়নের
কাছে ফিরে বললাম, “শিগগির কুড়ি টাকা বের কর।“
“বৌ… থুরি ঝিণ্টি কী বলল?”
“চুপ্ শালা।
দেব তোর গলাটা টিপে,” আমি ক্ষেপে গিয়ে ওর কলার ধরতে যাচ্ছিলাম। তারপরে মাথা ঠাণ্ডা
করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, ডিম্পি, মানে ওই ক্যাশিয়ার মেয়েটাকে চিনিস?”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান