‘বুদ্ধিবীজী’ যন্ত্রের সার্কিট পুড়ে ধোঁয়া বেরোতে দেখে তড়িঘড়ি কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। । প্রথম প্রচেষ্টাতেই সাফল্যের আশা করা অর্বাচীনতার সামিল। তাও হা-হুতাশ করতে গিয়ে খেয়ালই করিনি কখন আমার পরীক্ষা নিরীক্ষার সাবজেক্ট টিরগিটি, তার লম্বা লেজ খাড়া করে চেয়ারে উঠে বসেছে। সে’খান থেকেই গুরুজনদের মত জিজ্ঞাসা করল, “রাতে ঘুমাও না কেন?”
গবেষণায় মজে
থাকলে আমার চেতনা ধোঁয়াশায় স্লথ হয়ে যায়। টিরগিটির প্রশ্ন শুনে স্বভাবতই প্রথমে ঘড়ি
দেখলাম। আড়াইটে বাজে। তারপরে অবাক হয়ে ওর দিকে চাইলাম। সে ততক্ষণে লম্বা জিভ দিয়ে একটা
উড়ন্ত আরশোলা টেনে নিয়ে ডিনার সারছে। কি আভিজাত্যপূর্ণ সেই চর্বন। দেখলেই ভক্তি আসে।
কথা বলিয়ে টিরগিটি, মানে আমার প্রয়াস সাকসেসফুল। তবে ওর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত।
ইতস্তত করে বললাম, “অনেক কাজ ভায়া। ঘুমুলেই সময় নষ্ট।“
“ওই করে ইতিমধ্যেই
ব্রেনে একগাদা বিটা-অ্যামাইলয়েড জমা করেছ। ডিমেনশিয়া ধরল বলে,”
টিরগিটি ভাবলেশহীন হয়ে বলল। নিজের হাতে টিকটিকি আর গিরগিটির সংমিশ্রণে একে বানিয়েছিলাম।
আর, এখন তার বেজায় দেমাক। কিন্তু সে’সব ভাবার সময় কোথায় আমার। মনুষ্যেতর
প্রাণীর মধ্যে বুদ্ধির বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছি। আনন্দে উদ্বাহু নৃত্য করতে
ইচ্ছে করছে। কোনও মতে বললাম, “ও’সব ওষুধে সেরে যাবে।“
“ইকনমিক জাস্টিফিকেশনটা কী হে?’ টিরগিটি বিরক্ত হয়ে বলল। “অকারণে ফার্মা কোম্পানিগুলোকে
বড়লোক করবে। তারচে’ গভীর ঘুম দিলে মগজের গ্লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমটা ফ্রি-তেই ঝাড়পোঁছ
করে দেবে আবর্জনা।“
আমি ততক্ষণে
গড় হয়ে ‘বুদ্ধিবীজী’ মেশিনটাকে প্রণাম করছি। এর ব্যবসায়িক সাফল্য নিশ্চিতরূপেই আকাশচুম্বী
হতে চলেছে। টিরগিটি যে নিমেষের মধ্যে এমন সর্ববোদ্ধা হয়ে যাবে তা আমি আশাই করিনি। ভেবেছিলাম
খুব বেশি হলে আঁকজোঁক করার মতন চৈতন্য হবে। এযে রীতিমত সোনায় সোহাগা। ওকে খুশি করতে
আরও দুটো আরশোলা ঝাঁটা মেরে কাছে নিয়ে আসলাম। সেগুলোও পটাপট ওর পেটে চালান হয়ে গেল
মুহূর্তের মধ্যে। বুদ্ধি বাড়লে খিদেও নিশ্চয়ই বাড়ে।
বিজ্ঞানীকে
অত্যাধিক উচ্ছ্বসিত হতে নেই। তাই গলায় গাম্ভীর্য এনে জানতে চাইলাম, “গ্লোবাল ওয়ার্মিং
নিয়ে কোনও বক্তব্য আছে তোমার?”
“অবশ্যই আছে।
আচ্ছা বল, আফ্রিকান স্প্রিংহেয়ারের একটা প্রজাতি অন্ধকারে গোলাপি আভায় জ্বলে কেন?”
আচমকা পাল্টা
জিজ্ঞাস্যে থতমত খেয়ে গেলাম আমি। আমতা-আমতা করে বললাম, “ঠিক জানি না।“
“কারণ ওরা বায়োফ্লুরোসেন্ট। ওদের লোমে পর্ফিরিন থাকে।
অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে,” চিবিয়ে-চিবিয়ে, ধীরে সুস্থে উত্তর দিল সে।
আমি ঈষৎ ভেবলে
গেলাম। বললাম, “এর সঙ্গে আবহাওয়ার কী সম্পর্ক?”
“কিচ্ছু না।
তোমাকে এমনি-এমনি ঘেঁটে দিলাম,” টিরগিটি-র শরীরে লাল, সবুজ, কমলার ছটা খেলে গেল পরপর।
সে উদ্ধতভাবে চেয়ে রয়েছে টেবিলের কোণায়, একটা নিরুপায় মাছির দিকে।
‘বুদ্ধিবীজী’
যন্ত্রের পারদর্শিতা আর আমার নৈপুণ্যে আজ আমিই বিমোহিত। নিজের গরিমা ঢাকতে পারলাম না
আর। অস্ফুটে বলে ফেললাম, “পারফেক্ট!”
ভাবলাম, কাল
সকালে খাঁচায় পড়া নেংটি ইঁদুরের ওপরে আরেকটা এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলব। কিন্তু দেখলাম
টিরগিটি-র মাইন্ড রিডিংয়ের ক্ষমতাও রয়েছে। আমার দিকে ভুরূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “খবর্দার।
মুড়িমুড়কি এক দর করবে না। শেষে নেংটি! সামাজিক স্ট্যাটাস বলে কিছু আছে তো নাকি?”
দমে গেলাম।
বললাম, “ঠিক আছে। যাই গিন্নী-কে সুসংবাদটা দিয়ে আসি।“
“দেখলেন? না ঘুমানোর ফল?” আরও
গম্ভীর হয়ে গেল টিরগিটি। “আপনার অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। গিন্নী পেলেন
কোথায়?”
“ঘরে যেটা রয়েছে…?”
“ওটা পাশ-বালিশ।“
ইনি যখন এত
আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলছেন তখন তাই হবে। শোয়ার ঘরের বিছানায় নিঃশব্দে হাত-পা ছুঁড়লাম উল্লাসে।
ল্যাবে বুদ্ধিবীজী বানানো সোজা কথা নয়। নোবেল এল বলে।
“লাথি মারছ কেন ছোটলোকের মতন?” খন্খনে চিৎকারে ঘাবড়ে গেলাম। পাশ-বালিশও চোখ রাঙাচ্ছে, কি আশ্চর্য! এটাকেও যন্ত্রে ট্রাই করে দেখব নাকি?