“একি!”
চমকে উঠলেন
অমলবাবু। তাঁর চোখ আটকে রয়েছে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কামরূপ এক্সপ্রেসের এস ১৩ কামরার
দিকে। সামনের দরজা থেকে পাঁচটা জানালা পিছিয়ে এলে গরাদের ফাঁক দিয়ে যে লোকটাকে দেখা
যাচ্ছে, তাকে তিনি চেনেন। বাম গালের কুৎসিত জরুল, ভুরূর ওপরে কাটা দাগ, টিয়াপাখির ঠোঁটের
মতন খাড়া নাক আর কোটরাগত দুটো চোখ। সবই মিলে যাচ্ছে। সমরেশ-কে চিনতে ভুল হওয়ার কথা
নয় তাঁর। চকিতে নিজেকে গুটিয়ে বেঞ্চের পিছনে, প্ল্যাটফর্মের ধুলোয় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন
তিনি। ট্রেনটা না যাওয়া পর্যন্ত এখানে লুকিয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
মাঝেমধ্যে ভরদুপুরে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে এসে বসে থাকেন অমলবাবু। এখানে বেশীরভাগ সময় ঝ্যাংক্ল্যাং শব্দ করে মালগাড়িগুলো আসে। দু’একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়ালেও বোতলে জল ভরার প্রয়োজন না থাকলে প্ল্যাটফর্মে কেউই সাধারণত নামে না। মিনিট পাঁচেকের হৈচৈয়ের পরেই শান্ত হয়ে যায় চারিদিক। ওভারব্রিজের মাথা ডিঙ্গিয়ে রোদ্দুর মাখা আকাশে মনখারাপের ঘুড়ি যখন একলা-একলা পাক খায় তখন চকচকে রেল লাইনগুলো যে কি লোভনীয় লাগে তা কেবলমাত্র অমলবাবুই বোঝেন। আজও তাঁর মন ভালো নেই। সকালে গিয়েছিলেন সাত মাসের পাওনা বাড়িভাড়ার তাগাদা করতে। লাজুক ভাবেই চেয়ে চিন্তে হাত পেতেছিলেন। কিন্তু ভাড়াটিয়া বেজায় রেগে পাড়ার গুন্ডা ডেকে আনল। তারপরে দেদার গালিগালাজ আর গলাধাক্কার উপহার। বলল ক্লাবে এসে দলিল জমা করে যেতে, নইলে রাস্তায় ফেলে মারবে। এপর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। আসল মুশকিলটা হল অমলবাবু বাড়ির দলিল কোথায় আছে সেটাই জানেন না। মামাবাবু বলে যাওয়ার সময় পাননি। এমন নিঃসঙ্গ অসহায় পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষ বন্ধু খোঁজে। অথচ অমলবাবু বারবার মাথা ঝাঁকালেন। সমরেশ-কে তাঁর বেজায় ভয়। মা বলতেন, সে এলে বিপদ দশ গুন বেড়ে যায়।
তাকে শেষ দেখেছিলেন
বছর চল্লিশ আগে। তিনসুকিয়া ছেড়ে চলে আসার সময় বাসস্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ টিপেছিল।
অমলবাবুর বাবার চাকরী ছিল ডিগবয়ে। সেই সূত্রেই নর্থ আসামে বসবাস। মিশনারি স্কুলে চলত
পড়াশোনা। কিন্তু কেউই মিশত না ওনার সাথে। বরং রাস্তাঘাটে ছেলেপুলেরা পিছনে লেগে অকারণে
দুঃসহ করে তুলত বিকেলগুলো। সেই ঘরকুনো আঁধারেই একদিন হঠাৎ ছাদের সিঁড়িতে আলাপ হয়েছিল
সমরেশের সাথে। একেবারে বিপরীত স্বভাবের ছেলে। যত্রতত্র বেয়াড়াপনা করতে তার উৎসাহের
কখনও ঘাটতি হত না। অবশ্যি এই চারিত্রিক বৈপরীত্যের জন্যেই হয়তো ওদের সখ্যতা এত গাঢ়
হয়েছিল।
গোলমাল হল সেখানেই।
তিনি যা পারতেন না, ও নিঃশব্দে সেরে আসত তা অবলীলায়। তাঁর কোনও বারণই কানে তুলত না
সমরেশ। তবে ওর সকল দুষ্টুমির দায় অদ্ভুত ভাবে এসে পড়ত ওনার কাঁধেই। কঠিন সাজা পেয়েও
মুখ খুলতেন না তিনি। স্থানীয় উপজাতি নেতার ছেলে দারুক বোরা একদিন ঢিল মেরে অমলের কপাল
ফাটিয়ে দিল। তার দিন সাতেক পরেই কে যেন ছেলেটাকে পিছন থেকে বস্তায় পুরে জম্পেশ পেটাল
টিঙরাই নদীর চরায়। স্বাভাবিকভাবেই ওরা দুষল কিশোর অমল-কে। দাঙ্গা প্রায় বাঁধে বাঁধে।
বেদম ঠ্যাঙানি খাওয়ার ভয়ে প্রথমবার বন্ধুর নাম ফাঁস করেছিলেন তিনি। কিন্তু কেউ সমরেশ-কে
চিনল না। উল্টে ডাক্তারজেঠু ওকে বললেন, ‘প্যাথলজিকাল লায়ার’। বাবা তাঁকে জলপাইগুড়িতে
মামারবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। তারপরে বহু বছর কেটেছে। ঘুমিয়ে, ঝিমিয়ে মুছে গেছে অবশিষ্ট
মেরুদণ্ড। বিস্মৃতির আড়ালে নিখোঁজ হয়েছে সমরেশও।
ঘন-ঘন দু’বার
হুইসেল দিয়ে ইঞ্জিন ড্রাইভার জানান দিল যে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। আবার হারিয়ে যাবে
সমরেশ। তাকে শেষবারের মত দেখবার আশায় অমলবাবু বেঞ্চের পিছন থেকে উঁকি দিলেন। আর তাতেই
ওঁর বুক ধড়াস করে উঠল। জানালার রডে মুখ লাগিয়ে সোজাসুজি এইদিকেই চেয়ে রয়েছে সে। ঠোঁটের
কোণে বাঁকা হাসিতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে লুকোচুরির কৌতুক।
পড়িমরি করে
দৌড়ে নিকটস্থ শৌচালয়ে ঢুকে, দরজার আড়ালে দাঁড়ালেন অমলবাবু। ধরা পড়ে গেছেন তিনি। তবে
দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকা হৃদস্পন্দনের সাথে তিনি অনুভব করলেন মন খারাপ আর নেই।
উল্টোদিকে, আয়নায় নিজের প্রতিফলন দেখে রোজের মত মুষড়ে পড়লেন না। দেখলেন, ফিরে এসেছে
গর্তে ঢোকা চোখের উজ্জ্বলতা। বাম গালের জরুলটাকেও কুৎসিত দেখাচ্ছে না আর। সমরেশ নেমে
পড়েছে প্ল্যাটফর্মে। এবারে নিশ্চিন্তি।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান