খাতাটা নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল গাহিজি। ছন্দ মিলছে না, ভাবও আসছে না। একসময় বিড়বিড় করেই বানিয়ে ফেলতে পারত মনে-মনে কত কি। আজকাল শুকিয়ে যাচ্ছে কবিতাগুলো। এরচে’ সূর্যাস্ত দেখা
ঢের ভালো। হতাশ হয়ে জিপের বনেটের ওপরে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে। এক আকাশ ভরা পাখির দল বাড়ির পথে ঝাঁক বেঁধে শেষ কয়েকবারের ঘুরপাক খেয়ে নিচ্ছে। লাল গোল্লাটা ভিরুঙ্গা পাহাড়ের মাথার কাছে খানিকক্ষণ দম নিয়ে অপেক্ষা করছে ঝুপ করে হারিয়ে যাওয়ার আগে। ওখানে আছে বিরাট লেক বুরেরা। ছেঁড়া-ছেঁড়া কিছু ছবি ভেসে এলো গাহিজি-র মনে। মা বলত, ওই হ্রদের জলেই নাকি রাতে গা ডুবিয়ে থাকে সূর্য। দিদি মানতে চাইত না। রুসুমু-তে মাসির বাড়ি ঘুরতে গিয়ে লেকের পাশে গোটা বিকেল কাটিয়েও সূয্যিমামার জলকেলির কোনও প্রমাণ পায়নি ও। বরং তার ধারণা ছিল সূর্যটা নিশ্চয়ই ভিরুঙ্গা-র আগ্নেয়গিরিগুলোর মধ্যে গিয়ে লুকোয়। এদিকে গাহিজি-র পছন্দ লেক। সুতরাং তর্কবিতর্ক, চুল টানাটানি শুরু হয়ে যেত দুই ভাইবোনের মাঝে। মা হয়রান হয়ে শেষমেশ ভয় দেখাত, বাবা ফিরলেই নালিশ করে দেবে। ওতে কাজ হত ম্যাজিকের মতন। দুজনেই গুটিসুটি মেরে এক কোণায় গিয়ে বসে থাকত। বাবা-কে তখন খুব ভয় পেত গাহিজি। রাগও হত। যত পুতুল খেলনা সব দিদির। গাহিজি-র জন্যে শুধু একটা কবিতা লেখার খাতা। এখন মনে হয়, ভাগ্যিস।
“ওঠ শালা। খালি
শুয়ে থাকলে একদিন হাড় মজ্জা সব জমে যাবে,” মুখ খারাপ করতে-করতে গাহিজি-র পায়ে সপাটে
লাথি মারল মুগিশা। নেশায় টলছে বুড়োটা। সারা গায়ে রক্তের ছিটে।
“দিলে ত’ বারোটা
বাজিয়ে…,“ বিরক্ত হয়ে বলল গাহিজি। টুকরো-টুকরো স্মৃতিগুলো যখনই জোড়া দিতে বসে ও, তখনই
মুগিশা এসে জ্ঞান জাহির করা শুরু করে। শুয়ে থেকেও আর শান্তি নেই। বাতাস পশ্চিমে বইছে।
কালো ধোঁয়ার পাক খাওয়া মেঘ সূর্যাস্তের মেজাজ নষ্ট করে দিয়েছে। সঙ্গে একটা মাংস ঝলসানোর
গন্ধও আসছে। গেল রবিবার ক্যাম্পে ইমবোগো, মানে মোষের মাংস পোড়ান হয়েছিল। অনেকটা সেই
রকম। ও কান পেতে রইল কিছুক্ষণ। চিল্লাচিল্লি আর শোনা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ভেসে আসা
চাপা র্যাট্-ট্যাট্-ট্যাট্ শব্দগুলো হঠাৎ শুনলে মনে হবে যেন এক অজানা কাঠঠোকরার
ব্যস্ততা। আসলে ওগুলো মেশিনগানের আওয়াজ। এথনিক ক্লিন্সিং সোজা ব্যাপার নয়।
“ভুলে যাস না
যে তুই উমুতুতসি। তোর বাবা বিকিজা বিরাট লিডার ছিল। সেই জায়গা নেওয়ার আগে তোকে মরদ
হতে হবে। কি সারাক্ষণ কবিতা-কবিতা করিস?” গাহিজি-র মাথায় বন্দুকের বাঁট দিয়ে খোঁচা
মেরে বলল মুগিশা। ছেলেটাকে তাগাদা দিয়ে-দিয়ে সে ক্লান্ত। বিকিজা-র মত ওর চোখেও আগুন
আছে। বছর পাঁচেক আগে কারাম্বোর জঙ্গল থেকে বন্ধুপুত্রটিকে উদ্ধার করেছিল সে। তখন থেকেই
আশায় বুক বেঁধে রয়েছে। বদলার আশা। কিন্তু ওর এসবে উৎসাহই নেই। ছোকরার এতো ভালো নিশানা
বন্দুকে, অথচ হরিণ, বাইসন মারা ছাড়া আর কোনও কাজে লাগল না। বাকিরা যখন চপারের গায়ে
লেগে থাকা রক্ত মুছতে নিবিষ্ট, তখন সে কিনা পোড়া ঘরগুলোর ভিতরে বই খুঁজছে! অদ্ভুত সব
আচরণ। আজ যেমন গেলই না সঙ্গে। যাকগে, ন্যামোগালি-র শহরতলিতে এই মরাং গ্রামটায় কাজ মোটামুটি
সেরে এনেছে মুগিশা-র গ্যাং। এখানকার বাসিন্দারা সবাই ছিল হুতু উপজাতির। তাই কোপানোর
আগে ঝাড়াই বাছাই বিশেষ করতে হয়নি তাকে। এরকম আরও দুটো গ্রাম জ্বালাতে পারলেই এক পক্ষকালের
কোটা পূরণ হয়ে যাবে। পদোন্নতি হবে মুগিশা-র।
অটোমেটিক রাইফেলটাকে
পেটের ওপর থেকে সরিয়ে উঠে বসল গাহিজি। কষ্টিপাথরের গায়ে খোদাই করে বানানো মূর্তির ন্যায়
পেশীবহুল সুঠাম শরীরে পিছলে পড়ল লাল সূর্যের আলো। মুগিশা বলে, একদিন সে অনেক বড় হবে।
বন্দুক আর কলম দুটোতেই যে সে দক্ষ। যোগ্য নেতা হওয়ার সুলক্ষন নাকি সেগুলো। সত্যি মিথ্যে
বোঝে না গাহিজি। ভাবতে ভালোই লাগে। ন্যামোগালি থেকে আরম্ভ করে দেশের রাজধানী কিগালি
পর্যন্ত সকলেই বেশ ওকে এক নামে চিনবে। তবে আতঙ্কে নয়, ভালোবাসায়। মুগিশা মানতে চায়
না। কানের কাছে অনবরত ভনভন করে মনে করাতে থাকে রুয়ান্ডার গণহত্যার
কথা। গুনে গুনে একশ দিন ধরে চলেছিল। শয়ে নয়, হাজারে নয়, লাখে লাখে তুতসি-দের পোকা মাকড়ের
মত খুন করেছিল হুতু-রা। প্রতিশোধ নিতে চায় তাই মুগিশা। বুনো কুকুরের মত দলবেঁধে ঘুরে
বেড়ায়, গ্রাম থেকে গ্রামে, হুতু-দের খোঁজে। মৃত্যুর পরোয়ানায় ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, শিশু
কারোর ছাড় নেই। মুশকিল হয়েছে শুধু গাহিজি-র। কবিতার ছন্দ আর সে মিলিয়ে উঠতে পারছে না।
“যাহ্, এখনও
জান বাকি আছে শালির। মজা লুটে নে,” ফস করে সিগারেট ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল মুগিশা।
হাতের ইশারায় দেখাল কাঁচা রাস্তার ওপাশে দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমির দিকে।
“নাহ্! আমার
ভালো লাগছে না,” অস্ফুটে বলল গাহিজি।
“তবে রে!” এক
লাফে ঘাড়ের কাছে এসে কবিতার খাতাটা কেড়ে নিল মুগিশা। চোখ লাল করে বলল, “সবসময় কোঁচড়ে
নিয়ে ঘুরিস তুই। নে, জ্বালিয়ে দিলাম। না গেলে ঘিলু উড়িয়ে দেব এরপর।“
জ্বলে ওঠা কাগজগুলোর
দিকে ভাবলেশহীন হয়ে চেয়ে রইল গাহিজি। শেষ স্মৃতিটাও গেল। ওর ঘাড় ধরে ঠেলতে-ঠেলতে মুগিশা
নিয়ে গেল ঘাস বনের দিকে। আজ ওকে মানুষ করেই ছাড়বে সে। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।
“প্যান্ট খোল…
কীরে? ভাবছিসটা কী? এখনও বেঁচে আছে। মাইরি বলছি।”
মাটিতে শুইয়ে
রাখা তালগোল পাকানো শরীরটার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল গাহিজি। ওকে ধাক্কাধাক্কি
করতে লাগল দলের বাকি জন্তুরা। গাহিজি ভাবল, এই জিনিসটা জ্যান্ত? সত্যি? হ্যাঁ ওই ত’,
কণ্ঠনালীর কাছে রক্তের বুদ্বুদ হচ্ছে একটু পরে পরে। মানে শ্বাস চলছে। ওইটুকুই। অবশিষ্ট
রক্তস্নাত অবয়বটায় পোশাক বা প্রাণের আর কোনও চিহ্ন নেই। তবে মেয়েটার ঘোলাটে দৃষ্টিতে
ভয় কোথায়? বরং একরাশ ঘেন্না নিয়ে চোখদুটো দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে। হতভাগ্য দেহটার মায়া
কাটিয়ে যেন অন্য এক জগতে ইতিমধ্যেই চলে গেছে তার মন। মার্সি কিলিংয়ে পুণ্যি হয়? গাহিজি-র
যে অনেক পুণ্যির দরকার।
তাকে কিছু করতে
হল না। রক্তের বুদ্বুদ নিভে গেল আপনা থেকেই। মরেও শান্তি আছে নাকি? মুগিশার সাঙ্গোপাঙ্গরা
মেশেটি নিয়ে দেহাংশের সুভেনির সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
গাহিজি এক দৃষ্টে চেয়ে রইল নিঃস্পন্দ অভাগিনির চোখের দিকে। যে দিকে তাকিয়ে ছিল সে মুগিশাও
পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকেই। সাভানা গ্রাসল্যান্ডে হারিয়ে গেলে কাউকে খুঁজে পাওয়া
নাকি বেশ শক্ত। মোটেই তা নয়। সোনালী ঘাসে রক্তের দাগ অনুসরণ করলেই হয়। পিছু নিল গাহিজিও।
একটু পরে দেখতে পেল সামান্য খোলা জায়গা। সেখানে মুগিশা সহ ওদের দলের আরও দুজন কোমরে
হাত রেখে দাঁড়িয়ে। ওদের সামনে জড়সড় হয়ে রয়েছে দুটো পুঁচকে ছেলে মেয়ে। মেয়েটা একটু বড়
ছেলেটার চে’। দিদি হবে হয়তো। ভাইকে আগলে রেখেছে বুকের মধ্যে। সহোদরটিকে বাঁচিয়ে রাখার
দায়িত্ব মা তাকে দিয়ে গেছে।
অবসন্ন হয়ে
গেল গাহিজির শরীর। ছেঁড়া স্মৃতিগুলো আবার জমাট বাঁধছে মাথার ভিতরে। পাঁচ বছর আগে এমনই
কিছু ঘটেছিল না? একটা ভয়ানক ঝড়ের রাত। তারপরে ছত্রখান হয়ে গেছিল ছোট্ট সংসারটা। মনে
পড়ল, দরজায় হিংস্র করাঘাতের শব্দ। বাবা পিছনের দরজা দিয়ে বের করে দিয়েছিল ওদেরকে। বলেছিল,
“প্রতিবেশীই ত’। কথা বলে ঠিক সামলে নেব। সাবধানের মার নেই, তাই তোমরা লুকাও।“ ভাইবোন
মায়ের পিছু-পিছু এসে লুকিয়েছিল ভাঙ্গা ইউক্যালিপটাস গুঁড়ির আড়ালে। বাবা ঠিক আসবে ফেরত
নিতে। কিন্তু প্রহর কেটে যেতেও বাবার দেখা না পেয়ে মা গ্রামে গেল খুঁজতে। আর আসেনি।
একটা গোটা দিন আর গোটা রাত ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরেছিল দিদিটা। তারপরে খুব তেষ্টা পেয়েছিল গাহিজির। দিদিকে বলেছিল, “জল খাব।“
“আনছি। তুই
বসে থাক এখানে। এক পাও নড়াবি না,“ দিদি গেল জলের খোঁজে। কবিতার খাতা বুকে আঁকড়ে এখনও
অপেক্ষায় রয়েছে সেই ভাই।
“এই নে। হাত
শুদ্ধি কর,” গাহিজির হাতে মেশেটি তুলে দিয়ে বলল মুগিশা। “এদের
জন্যে বেকার গুলি নষ্ট করিস না।“
“উমুতয়ারে মুগিশা,
মেয়েটাকে…,” লোভে চকচক করে ওঠা চোখে দলপতিকে বলল কারাঞ্জা। শিকারকে সহজে মারলে সাধ
মেটে না তার। এই নেশা ড্রাগের চেয়েও ভয়ংকর। গাহিজি জানে। তাই আর দেরী করল না সে। মেশেটির প্রচণ্ড কোপ বসাল কারাঞ্জার ঘাড়ে। ভারী মাথাটা ঘাস ছোঁয়ার আগেই
আবার হাত চলল তার। কাটা কলাগাছের মত গড়িয়ে পড়ল আরেকজনও।
“খবর্দার গাহিজি…,”
মুগিশার মুখের কথা শেষ না হতেই তার বন্দুক ধরা কব্জিটা হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে
লুটালো।
ডান হাতে মেশেটি
আর বাম হাতে উদ্যত কালাশনিকভ, গাহিজির এমন রুদ্ররূপ আগে কখনও দেখেনি কেউ। ছটফট করতে
থাকা মুগিশা-কে কুড়িয়ে নিয়ে কোনও মতে রণে ভঙ্গ দিল বাকিরা। বাচ্চা দুটোকে জিপে বসিয়ে
ধুলো উড়িয়ে রওনা দিল গাহিজি। মাইল দশেক দূরে ইউনাইটেড নেশন্সের ক্যাম্প। অনেক বড় পুরস্কার
রয়েছে ওর মাথায়। সারেন্ডার করলে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হতে পারে। যা হবে
দেখা যাবে। আপাতত দারুণ আনন্দ হচ্ছে গাহিজির। প্রাণ বাঁচানোর মাদকটা যে আরও অনেক স্ট্রং। পুরো মাতাল করে দেয়। শুকনো ছন্দের খাতে ছুটিয়ে দেয় ফল্গুধারা।
বিড়বিড় করে আবৃত্তি করতে থাকলো সে আজ অনেকদিন পরে-
“একলা
ভীষণ। অন্ধকারে যোগ বিয়োগের ভুলে,
পাতার
মাঝে, বনের খাঁজে সূর্যের শীতলতা-
হারিয়ে
ফেলা স্নেহের মুঠো, স্বপ্নের ফাঁকে ছুঁলে,
রক্তজবার
পাপড়ির কানে ফিসফিস বারতা-
আমি
বেঁচে আছি…”
Osadharon barnona...
উত্তরমুছুনDarron hoyeche...👏👏👏
Thought provoking. Onek govirota aachhe ae chotto golpo tay.
উত্তরমুছুন