A book named Sid - Bengali Blog Site
I am sharing my creative writings in Bengali here in this blog. My fiction and non-fiction stories, poems and articles published in different online, social and print mediums are available here for avid readers.
রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২
বই হিমযুগ, গল্প স্কেচবুক - টিজার
শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২
বই হিমযুগ, গল্প মোবট
হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে নিজেকে একটা শূন্যে ভাসমান স্লিপিং পডের ভিতর আবিষ্কার করে বিতনু। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পায়, ও পৌঁছে গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে। বদলে গেছে চেহারা এবং পোশাকও। ওর কৌতূহল নিরসনে এগিয়ে আসেন এজে। তার পর তিনি এমন সব কথা বলেন, যা শুনে চমকের পর চমক লাগে বিতনুর।
কী এমন ঘটনা, যেগুলো শুনে চমকে উঠতে হয় বিতনুকে? এই এজে ভদ্রলোক আসলে কে, কী তাঁর পরিচয়? কোন ভয়ংকর সত্যি অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য গল্পের শেষে?
সব উত্তর পেতে পড়তে হবে আমার সায়েন্স ফ্যান্টাসি সংকলন ‘হিমযুগ’। গল্পের নাম ’মোবট’। প্রকাশিত হবে পুজোর আগেই।
সঙ্গের ছবি: উজ্জ্বল ধর
হিমযুগ: সিদ্ধার্থ পাল
এবারত প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: উজ্জ্বল ধর
অলংকরণ: দিলীপ দাস ও উজ্জ্বল ধর
বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০২২
বই হিমযুগ, গল্প হোয়াট ইফ
এজেন্সি ফর অ্যাবনর্মাল কেস স্টাডিজ— ভারত সরকারের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিভাগের একটি গোপন শাখা। যাদের কাজ হলো অদ্ভুত, অলৌকিক সব ঘটনার তদন্ত করা। এই ডিপার্টমেন্টের তরুণ অফিসার খোঁজ পায় এক আশ্চর্য বালকের; সুজাতা দেশমুখের ছেলে বাবুল দেশমুখ। যার আঁকা ছবির দৃশ্যগুলো ভবিষ্যতে বাস্তব রূপ নেয়। সত্যিই কি তাই? তদন্তে নেমে কী জানতে পারে আসিফ? গত কয়েক সপ্তাহের রেড অ্যালার্ট কোন ঘটনার বিপদ সংকেত?
সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২
বই হিমযুগ, গল্প এনসেলাডাস- টিজার
স্পেস ট্যুরিজম কোম্পানি ইনফিনিট হরাইজন টেন্ডার পেয়েছে শনি গ্রহের ষষ্ঠ উপগ্রহ এনসেলাডাসকে মনুষ্য বসবাসের উপযোগী করে তাতে পর্যটন ব্যবসা করার। প্রতি তিনটি রোবোটিক মিশনের পর একটি হিউম্যান মিশন— এই ফরম্যাট মেনে এবার এক বঙ্গ সন্তান লোচন এসেছে এনসেলাডাসে। সে কি পারল শনির হিমায়িত উপগ্রহটিকে পর্যটন ব্যবসার উপযোগী করে তুলতে? কোথায় গেল তার আগের অভিযাত্রী অ্যানা মারিয়া? যার সঙ্গে মিলেই কাজ করার কথা লোচনের। অ্যানার হ্যাবিটাট রোজ একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে কেন? সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে পারবে কি লোচন সফল হতে?
সোমবার, ৩০ আগস্ট, ২০২১
গাহিজি-র কবিতা
খাতাটা নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল গাহিজি। ছন্দ মিলছে না, ভাবও আসছে না। একসময় বিড়বিড় করেই বানিয়ে ফেলতে পারত মনে-মনে কত কি। আজকাল শুকিয়ে যাচ্ছে কবিতাগুলো। এরচে’ সূর্যাস্ত দেখা
ঢের ভালো। হতাশ হয়ে জিপের বনেটের ওপরে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে। এক আকাশ ভরা পাখির দল বাড়ির পথে ঝাঁক বেঁধে শেষ কয়েকবারের ঘুরপাক খেয়ে নিচ্ছে। লাল গোল্লাটা ভিরুঙ্গা পাহাড়ের মাথার কাছে খানিকক্ষণ দম নিয়ে অপেক্ষা করছে ঝুপ করে হারিয়ে যাওয়ার আগে। ওখানে আছে বিরাট লেক বুরেরা। ছেঁড়া-ছেঁড়া কিছু ছবি ভেসে এলো গাহিজি-র মনে। মা বলত, ওই হ্রদের জলেই নাকি রাতে গা ডুবিয়ে থাকে সূর্য। দিদি মানতে চাইত না। রুসুমু-তে মাসির বাড়ি ঘুরতে গিয়ে লেকের পাশে গোটা বিকেল কাটিয়েও সূয্যিমামার জলকেলির কোনও প্রমাণ পায়নি ও। বরং তার ধারণা ছিল সূর্যটা নিশ্চয়ই ভিরুঙ্গা-র আগ্নেয়গিরিগুলোর মধ্যে গিয়ে লুকোয়। এদিকে গাহিজি-র পছন্দ লেক। সুতরাং তর্কবিতর্ক, চুল টানাটানি শুরু হয়ে যেত দুই ভাইবোনের মাঝে। মা হয়রান হয়ে শেষমেশ ভয় দেখাত, বাবা ফিরলেই নালিশ করে দেবে। ওতে কাজ হত ম্যাজিকের মতন। দুজনেই গুটিসুটি মেরে এক কোণায় গিয়ে বসে থাকত। বাবা-কে তখন খুব ভয় পেত গাহিজি। রাগও হত। যত পুতুল খেলনা সব দিদির। গাহিজি-র জন্যে শুধু একটা কবিতা লেখার খাতা। এখন মনে হয়, ভাগ্যিস।
“ওঠ শালা। খালি
শুয়ে থাকলে একদিন হাড় মজ্জা সব জমে যাবে,” মুখ খারাপ করতে-করতে গাহিজি-র পায়ে সপাটে
লাথি মারল মুগিশা। নেশায় টলছে বুড়োটা। সারা গায়ে রক্তের ছিটে।
“দিলে ত’ বারোটা
বাজিয়ে…,“ বিরক্ত হয়ে বলল গাহিজি। টুকরো-টুকরো স্মৃতিগুলো যখনই জোড়া দিতে বসে ও, তখনই
মুগিশা এসে জ্ঞান জাহির করা শুরু করে। শুয়ে থেকেও আর শান্তি নেই। বাতাস পশ্চিমে বইছে।
কালো ধোঁয়ার পাক খাওয়া মেঘ সূর্যাস্তের মেজাজ নষ্ট করে দিয়েছে। সঙ্গে একটা মাংস ঝলসানোর
গন্ধও আসছে। গেল রবিবার ক্যাম্পে ইমবোগো, মানে মোষের মাংস পোড়ান হয়েছিল। অনেকটা সেই
রকম। ও কান পেতে রইল কিছুক্ষণ। চিল্লাচিল্লি আর শোনা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ভেসে আসা
চাপা র্যাট্-ট্যাট্-ট্যাট্ শব্দগুলো হঠাৎ শুনলে মনে হবে যেন এক অজানা কাঠঠোকরার
ব্যস্ততা। আসলে ওগুলো মেশিনগানের আওয়াজ। এথনিক ক্লিন্সিং সোজা ব্যাপার নয়।
“ভুলে যাস না
যে তুই উমুতুতসি। তোর বাবা বিকিজা বিরাট লিডার ছিল। সেই জায়গা নেওয়ার আগে তোকে মরদ
হতে হবে। কি সারাক্ষণ কবিতা-কবিতা করিস?” গাহিজি-র মাথায় বন্দুকের বাঁট দিয়ে খোঁচা
মেরে বলল মুগিশা। ছেলেটাকে তাগাদা দিয়ে-দিয়ে সে ক্লান্ত। বিকিজা-র মত ওর চোখেও আগুন
আছে। বছর পাঁচেক আগে কারাম্বোর জঙ্গল থেকে বন্ধুপুত্রটিকে উদ্ধার করেছিল সে। তখন থেকেই
আশায় বুক বেঁধে রয়েছে। বদলার আশা। কিন্তু ওর এসবে উৎসাহই নেই। ছোকরার এতো ভালো নিশানা
বন্দুকে, অথচ হরিণ, বাইসন মারা ছাড়া আর কোনও কাজে লাগল না। বাকিরা যখন চপারের গায়ে
লেগে থাকা রক্ত মুছতে নিবিষ্ট, তখন সে কিনা পোড়া ঘরগুলোর ভিতরে বই খুঁজছে! অদ্ভুত সব
আচরণ। আজ যেমন গেলই না সঙ্গে। যাকগে, ন্যামোগালি-র শহরতলিতে এই মরাং গ্রামটায় কাজ মোটামুটি
সেরে এনেছে মুগিশা-র গ্যাং। এখানকার বাসিন্দারা সবাই ছিল হুতু উপজাতির। তাই কোপানোর
আগে ঝাড়াই বাছাই বিশেষ করতে হয়নি তাকে। এরকম আরও দুটো গ্রাম জ্বালাতে পারলেই এক পক্ষকালের
কোটা পূরণ হয়ে যাবে। পদোন্নতি হবে মুগিশা-র।
অটোমেটিক রাইফেলটাকে
পেটের ওপর থেকে সরিয়ে উঠে বসল গাহিজি। কষ্টিপাথরের গায়ে খোদাই করে বানানো মূর্তির ন্যায়
পেশীবহুল সুঠাম শরীরে পিছলে পড়ল লাল সূর্যের আলো। মুগিশা বলে, একদিন সে অনেক বড় হবে।
বন্দুক আর কলম দুটোতেই যে সে দক্ষ। যোগ্য নেতা হওয়ার সুলক্ষন নাকি সেগুলো। সত্যি মিথ্যে
বোঝে না গাহিজি। ভাবতে ভালোই লাগে। ন্যামোগালি থেকে আরম্ভ করে দেশের রাজধানী কিগালি
পর্যন্ত সকলেই বেশ ওকে এক নামে চিনবে। তবে আতঙ্কে নয়, ভালোবাসায়। মুগিশা মানতে চায়
না। কানের কাছে অনবরত ভনভন করে মনে করাতে থাকে রুয়ান্ডার গণহত্যার
কথা। গুনে গুনে একশ দিন ধরে চলেছিল। শয়ে নয়, হাজারে নয়, লাখে লাখে তুতসি-দের পোকা মাকড়ের
মত খুন করেছিল হুতু-রা। প্রতিশোধ নিতে চায় তাই মুগিশা। বুনো কুকুরের মত দলবেঁধে ঘুরে
বেড়ায়, গ্রাম থেকে গ্রামে, হুতু-দের খোঁজে। মৃত্যুর পরোয়ানায় ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, শিশু
কারোর ছাড় নেই। মুশকিল হয়েছে শুধু গাহিজি-র। কবিতার ছন্দ আর সে মিলিয়ে উঠতে পারছে না।
“যাহ্, এখনও
জান বাকি আছে শালির। মজা লুটে নে,” ফস করে সিগারেট ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল মুগিশা।
হাতের ইশারায় দেখাল কাঁচা রাস্তার ওপাশে দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমির দিকে।
“নাহ্! আমার
ভালো লাগছে না,” অস্ফুটে বলল গাহিজি।
“তবে রে!” এক
লাফে ঘাড়ের কাছে এসে কবিতার খাতাটা কেড়ে নিল মুগিশা। চোখ লাল করে বলল, “সবসময় কোঁচড়ে
নিয়ে ঘুরিস তুই। নে, জ্বালিয়ে দিলাম। না গেলে ঘিলু উড়িয়ে দেব এরপর।“
জ্বলে ওঠা কাগজগুলোর
দিকে ভাবলেশহীন হয়ে চেয়ে রইল গাহিজি। শেষ স্মৃতিটাও গেল। ওর ঘাড় ধরে ঠেলতে-ঠেলতে মুগিশা
নিয়ে গেল ঘাস বনের দিকে। আজ ওকে মানুষ করেই ছাড়বে সে। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।
“প্যান্ট খোল…
কীরে? ভাবছিসটা কী? এখনও বেঁচে আছে। মাইরি বলছি।”
মাটিতে শুইয়ে
রাখা তালগোল পাকানো শরীরটার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল গাহিজি। ওকে ধাক্কাধাক্কি
করতে লাগল দলের বাকি জন্তুরা। গাহিজি ভাবল, এই জিনিসটা জ্যান্ত? সত্যি? হ্যাঁ ওই ত’,
কণ্ঠনালীর কাছে রক্তের বুদ্বুদ হচ্ছে একটু পরে পরে। মানে শ্বাস চলছে। ওইটুকুই। অবশিষ্ট
রক্তস্নাত অবয়বটায় পোশাক বা প্রাণের আর কোনও চিহ্ন নেই। তবে মেয়েটার ঘোলাটে দৃষ্টিতে
ভয় কোথায়? বরং একরাশ ঘেন্না নিয়ে চোখদুটো দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে। হতভাগ্য দেহটার মায়া
কাটিয়ে যেন অন্য এক জগতে ইতিমধ্যেই চলে গেছে তার মন। মার্সি কিলিংয়ে পুণ্যি হয়? গাহিজি-র
যে অনেক পুণ্যির দরকার।
তাকে কিছু করতে
হল না। রক্তের বুদ্বুদ নিভে গেল আপনা থেকেই। মরেও শান্তি আছে নাকি? মুগিশার সাঙ্গোপাঙ্গরা
মেশেটি নিয়ে দেহাংশের সুভেনির সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
গাহিজি এক দৃষ্টে চেয়ে রইল নিঃস্পন্দ অভাগিনির চোখের দিকে। যে দিকে তাকিয়ে ছিল সে মুগিশাও
পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকেই। সাভানা গ্রাসল্যান্ডে হারিয়ে গেলে কাউকে খুঁজে পাওয়া
নাকি বেশ শক্ত। মোটেই তা নয়। সোনালী ঘাসে রক্তের দাগ অনুসরণ করলেই হয়। পিছু নিল গাহিজিও।
একটু পরে দেখতে পেল সামান্য খোলা জায়গা। সেখানে মুগিশা সহ ওদের দলের আরও দুজন কোমরে
হাত রেখে দাঁড়িয়ে। ওদের সামনে জড়সড় হয়ে রয়েছে দুটো পুঁচকে ছেলে মেয়ে। মেয়েটা একটু বড়
ছেলেটার চে’। দিদি হবে হয়তো। ভাইকে আগলে রেখেছে বুকের মধ্যে। সহোদরটিকে বাঁচিয়ে রাখার
দায়িত্ব মা তাকে দিয়ে গেছে।
অবসন্ন হয়ে
গেল গাহিজির শরীর। ছেঁড়া স্মৃতিগুলো আবার জমাট বাঁধছে মাথার ভিতরে। পাঁচ বছর আগে এমনই
কিছু ঘটেছিল না? একটা ভয়ানক ঝড়ের রাত। তারপরে ছত্রখান হয়ে গেছিল ছোট্ট সংসারটা। মনে
পড়ল, দরজায় হিংস্র করাঘাতের শব্দ। বাবা পিছনের দরজা দিয়ে বের করে দিয়েছিল ওদেরকে। বলেছিল,
“প্রতিবেশীই ত’। কথা বলে ঠিক সামলে নেব। সাবধানের মার নেই, তাই তোমরা লুকাও।“ ভাইবোন
মায়ের পিছু-পিছু এসে লুকিয়েছিল ভাঙ্গা ইউক্যালিপটাস গুঁড়ির আড়ালে। বাবা ঠিক আসবে ফেরত
নিতে। কিন্তু প্রহর কেটে যেতেও বাবার দেখা না পেয়ে মা গ্রামে গেল খুঁজতে। আর আসেনি।
একটা গোটা দিন আর গোটা রাত ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরেছিল দিদিটা। তারপরে খুব তেষ্টা পেয়েছিল গাহিজির। দিদিকে বলেছিল, “জল খাব।“
“আনছি। তুই
বসে থাক এখানে। এক পাও নড়াবি না,“ দিদি গেল জলের খোঁজে। কবিতার খাতা বুকে আঁকড়ে এখনও
অপেক্ষায় রয়েছে সেই ভাই।
“এই নে। হাত
শুদ্ধি কর,” গাহিজির হাতে মেশেটি তুলে দিয়ে বলল মুগিশা। “এদের
জন্যে বেকার গুলি নষ্ট করিস না।“
“উমুতয়ারে মুগিশা,
মেয়েটাকে…,” লোভে চকচক করে ওঠা চোখে দলপতিকে বলল কারাঞ্জা। শিকারকে সহজে মারলে সাধ
মেটে না তার। এই নেশা ড্রাগের চেয়েও ভয়ংকর। গাহিজি জানে। তাই আর দেরী করল না সে। মেশেটির প্রচণ্ড কোপ বসাল কারাঞ্জার ঘাড়ে। ভারী মাথাটা ঘাস ছোঁয়ার আগেই
আবার হাত চলল তার। কাটা কলাগাছের মত গড়িয়ে পড়ল আরেকজনও।
“খবর্দার গাহিজি…,”
মুগিশার মুখের কথা শেষ না হতেই তার বন্দুক ধরা কব্জিটা হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে
লুটালো।
ডান হাতে মেশেটি
আর বাম হাতে উদ্যত কালাশনিকভ, গাহিজির এমন রুদ্ররূপ আগে কখনও দেখেনি কেউ। ছটফট করতে
থাকা মুগিশা-কে কুড়িয়ে নিয়ে কোনও মতে রণে ভঙ্গ দিল বাকিরা। বাচ্চা দুটোকে জিপে বসিয়ে
ধুলো উড়িয়ে রওনা দিল গাহিজি। মাইল দশেক দূরে ইউনাইটেড নেশন্সের ক্যাম্প। অনেক বড় পুরস্কার
রয়েছে ওর মাথায়। সারেন্ডার করলে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হতে পারে। যা হবে
দেখা যাবে। আপাতত দারুণ আনন্দ হচ্ছে গাহিজির। প্রাণ বাঁচানোর মাদকটা যে আরও অনেক স্ট্রং। পুরো মাতাল করে দেয়। শুকনো ছন্দের খাতে ছুটিয়ে দেয় ফল্গুধারা।
বিড়বিড় করে আবৃত্তি করতে থাকলো সে আজ অনেকদিন পরে-
“একলা
ভীষণ। অন্ধকারে যোগ বিয়োগের ভুলে,
পাতার
মাঝে, বনের খাঁজে সূর্যের শীতলতা-
হারিয়ে
ফেলা স্নেহের মুঠো, স্বপ্নের ফাঁকে ছুঁলে,
রক্তজবার
পাপড়ির কানে ফিসফিস বারতা-
আমি
বেঁচে আছি…”
শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১
দুই কাহন
বকুলদি আসছে না ক’দিন। রান্না কিছুই নেই ফ্রিজে। কালকে ভাত তরকারি অতিরিক্ত রয়ে গেছিল। কিন্তু টিফিন-বক্স খুলে গন্ধ শুঁকে রেখে দিল তিতির। টকে গেছে। ফ্রিজটা ঠিক মতন কাজ করছে না। এক গামলা দুধ নষ্ট হয়েছে দু’দিন আগে। তবে গরম যা পড়েছে, ফ্রিজ বেচারা কিই বা করবে। সময়, রাত পৌনে বারোটা। তিতিরের আলসেমি লাগল ঘড়ি দেখে। ঠিক করল, ম্যাগি দিয়ে আজকের ডিনারটা সেরে নেবে। সেইমতন রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিল, তখনই মোবাইল বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। উটকো উপদ্রব হবে খুব সম্ভবত। মরুকগে যাক। ও ফোন রেখে দিল ডাইনিং টেবিলে।
তিতির দু’মিনিটের
বেশি সময় নিয়েই ম্যাগি বানাল সসপ্যানে। ও’দিকে কাঠের ওপর মুঠোফোন ক্রমাগত ভাইব্রেশন
করে যাচ্ছে। কেউ জরুরী প্রয়োজনে বারবার ওকে খুঁজছে। তিতির সাম্ভাব্য কলার-দের অনুমান
করার চেষ্টা করল। রাজীবদা নয়, কারণ পুরনো অফিসের পাট চুকেবুকে গেছে অনেকদিন। বাড়িতেও
সে তেজ্যকন্যা। তাহলে হয় নতুন চাকরীর আহ্বান অথবা বিয়ে। নওক্রি এবং শাদি, দুটো ডট
কমেই পার্সোনাল নম্বর দেওয়া আছে। কিন্তু এত রাতে?
“হ্যালো! হু
ইজ দিস?”
তিতির প্রশ্নটা
করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ফোনের ওপারে কেউ একজন আছে। নড়াচড়ার শব্দ আসছে অথচ কথা বলছে
না। তিতির বারদুয়েক “হ্যালো” বলার পরে ফোন কাটতে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে ও’পাশ থেকে
ঘড়ঘড়ে পুরুষ কণ্ঠে কেউ বলল, “হ্যালো, মিতা?”
“রঙ নাম্বার।“
শাল্লা, মাঝ
রাত্তিরে কে আবার মিতা-কে খুঁজছে। মোবাইল রেখে ম্যাগির ঝোলে চুমুক দিয়ে একচোট হেসে
নিল তিতির। লোকটার গলা শুনেই মনে হয় নেশারু।
“গড সেভ বেচারি
মিতা… খ্যাঁক-খ্যাঁক!”
হাসি শেষ হতেই
খিদেটাও দুম করে হারিয়ে গেল। উদ্ভট শুঁটকো গন্ধ আসছে নুডল্সের পাত্র থেকে। খাওয়া যাবে
না। যদিও তাতে ক্ষতি বিশেষ নেই। কাঁচের বাহারি চামচটা বাটিতে অর্ধেক ডুবিয়ে গোটা চারেক
ছবি তুলে নিল। সঠিক ফিল্টার লাগিয়ে ইন্সটা-তে দিলে এক বালতি লাইক চলে আসবে। ওতে পেট
না ভরলেও মন ভরে। কারিকুরি শুরু করতে না করতেই বোঁ-বোঁ আওয়াজে নতুন মেসেজ ঢুকল।
“মিতা, ম্যাগির
প্যাকেটগুলো পুরনো। এবারে ফেলে দাও।“
অবাক হল তিতির।
মিলিয়ে দেখল, লাস্ট ইনকামিং কল আর এই মেসেজ প্রেরকের নম্বর আলাদা। অথচ দুজনেই মিতা-কে
সম্ভাষণ করছে। একই ব্যক্তি সিম কার্ড বদলে চালাকি করছে নির্ঘাত। কিন্তু ম্যাগির বিষয়ে
জানল কীভাবে? দ্রুত চারিদিকে তাকাল ও। বেডরুমে এসি লাগানো তাই ঘরের জানালা সব বন্ধই
রয়েছে। সুতরাং বাইরে থেকে ওর ওপরে নজর রাখা সম্ভব নয়। পরিচিত কেউ কৌতুক করছে না ত’?
আবীরের সঙ্গে ব্রেক-আপটা সমঝোতা করে হয়নি। ফোন করে শাসিয়েছিল সে কবার। হয়তো শয়তানিটা
ওরই।
চোখের পাতা
ভারী হয়ে আসলেও তিতির রিমোট নিয়ে সোফায় বসল। মুভি সার্ফিং অনেকসময় ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসির
কাজ করে। কিন্তু আজ টিভি অন হতেই ঘুম চটে গেল। নেটফ্লিক্সের লগ-ইন স্ক্রিনে জ্বলজ্বল
করছে প্রোফাইল নেম “মিতা”।
তিতিরের কাছে
ব্যাপারটা আর ইয়ার্কি নয়। কেউ ওর ঘরে ঢুকে টিভ-র সেটিং বদলে দিয়েছে ভাবলেই গা শিরশিরিয়ে
উঠছে। কে জানে আর কী করে গেছে বদমাশটা। গোপন ক্যামেরা লাগায়নি ত’ কোথাও? হঠাৎ নিজেকে
ভীষণ অরক্ষিত মনে হল তিতিরের। সোফা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পাগলের মতন খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করল
দু’কামরার ঘরটায়। ঘুলঘুলি, বইয়ের তাক, টিউব লাইটের পিছন থেকে শুরু করে সিলিং ফ্যান,
এসি, জানালা, দরজা কিছুই বাদ রাখল না সে। আধঘণ্টা পরে ঘর্মাক্ত কলেবরে তিতির এসে বসল
ডাইনিং টেবিলের পাশের চেয়ারে। সন্দেহজনক কিচ্ছু নেই। শুধু মোবাইলে নতুন টেক্সট বলছে,
“কিছু খুঁজছ? হাঁপিয়ে গেলে বড্ড।“
“হু দ্য হেল
আর ইউ?” ক্ষিপ্র হাতে টাইপ করল তিতির। “এনাফ অফ দিস জোক!”
বার্তা পৌঁছালো না। ফোন নম্বরটি ইনভ্যালিড। ও বুঝল, এগুলো সফটওয়্যার জেনারেটেড
ফেক আউটগোয়িং নম্বর। আগেভাগেই টাইম দিয়ে শিডিউল করে রাখা যায় কখন মেসেজ যাবে। পাল্টা
যোগাযোগ করার চেষ্টা করে লাভ হবে না। অ্যাপটা ওর নিজের মুঠোফোনেও রয়েছে। মনে আছে ওর,
ম্যানেজার রাজীবদা একসময় কি টেনশনেই না থাকত অজানা প্রেরকের ভয় পাওয়ানো মেসেজের ঠেলায়।
কীভাবে যেন লোকটা আন্দাজ করেছিল ষড়যন্ত্রের পিছনে তিতিরই রয়েছে। চাকরীটা গেল সেই কারণেই।
রাজীবদা আজ বদলা নিচ্ছে নাকি?
মাথায় দুশ্চিন্তার
বোঝা নিয়ে মোবাইল হাতে শুতে গেল তিতির। খেয়াল নেই কখন হোয়াটস্অ্যাপের নোটিফিকেশন মিউট
করে রেখেছিল। ইনবক্স খুলতেই রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গেল। প্রচুর নতুন অপঠিত
মেসেজ পড়ে আছে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সকলে ওকে হঠাৎ কী বলতে চাইছে? কোনও
খারাপ খবর নেই ত’? দুরুদুরু বুকে শুচি-র টেক্সট খুলল তিতির। ও লিখেছে, “কনগ্রাচুলেশন্স!
লাইফ চেঞ্জড আর সাথে নামও? আমায় জানালে কি এমন দোষ হত?”
হতভম্ব হয়ে
বসে রইল তিতির মিনিট খানেক। তারপরে ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে যেতেই বুঝল, অ্যাকাউন্ট
হ্যাক্ড হয়েছে। ডিপি-তে এক নব্য বিবাহিত দম্পতির ছবি। মেয়েটা যে তিতির নিজে তাতে কোনও
সন্দেহ নেই। লাইফ ইভেন্টে দেখাচ্ছে যে আজই তার বিয়ে হয়েছে রক্তিমের সঙ্গে। রক্তিম গোস্বামী,
বাড়িওয়ালা রূপক বাবুর ছেলে। ছিঃ, কি কেলেঙ্কারি কাণ্ড! লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়।
ভাড়া বাড়ির ঠাঁইটাও যাবে এইবার।
নিজের প্রোফাইল
খুঁটিয়ে দেখল তিতির। এখানেও মিতা। অন্তত বায়ো-তে সেই নামই রয়েছে। ছবিটা? ধোঁকা খেয়ে
গেছিল সে প্রথমে। দুটো আলাদা ছবি নিখুঁত ভাবে জোড়া ফটোশপে। কোয়েলের বিয়েতে মেরুন বেনারসি
পরেছিল ও। পরে সে’দিনের তোলা একলা ফটোটা দিয়েই শাদি ডট কমে খুলেছিল নতুন অ্যাকাউন্ট। ওখান থেকেই ঝেড়েছে নিশ্চয়ই। রক্তিমের ছবিটা সম্ভবত পুরনো। ও
ফেসবুকে নেই।
“আবীর, ইউ ব্লাডি
স্কাউন্ড্রেল…”
রাগে গরগর করতে-করতে
তিতিরের মনে পড়ল ফ্ল্যাটের একটা ডুপ্লিকেট চাবি আবীরের কাছে ছিল। ফেরত নেওয়া হয়েছে
কি? ওকে না পাওয়ার জ্বালা জুড়োতে ছেলেটা এমন নিচে নামবে সে কল্পনাও করতে পারেনি। রক্তিমকেও
এর মধ্যে টেনে এনেছে। তিতির ঠিক করল, এর শেষ দেখে ছাড়বে। সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে
আজই এফআইআর করবে। থানার নম্বর ওর কাছে নেই। বাড়িওয়ালা রূপক বাবু-র কাছে হয়তো থাকবে।
তবে তিনি ঘণ্টা খানেক আগে অনেক লোকজন সাথে নিয়ে বেরিয়ে ছিলেন। ফিরে এসেছেন কি? মধ্যরাত্রে
বেল বাজালে আবার রেগে যাবেন না ত’?
বেল বাজল, তবে
সেটা তিতিরের দরজায়। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবল, খুলবে কিনা। আই-হোল থাকলে
উঁকি মেরে দেখা যেত কে এসেছে। হতে পারে রূপক বাবু তিতিরের খোঁজ নিতে এসেছেন। সাহস করে
সে লক ঘুরিয়ে দরজাটা খুলেই ফেলল।
“একি! রক্তিম
তুমি?”
বিহ্বল তিতির-কে
পাশে রেখে ছেলেটা ঘরের ভিতরে ঢুকল। ভাগ্যিস রক্তিম সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। থাকলে বিড়ম্বনার
একশেষ হত। কিন্তু ওর আচার আচরণ অত্যন্ত অদ্ভুত লাগছে তিতিরের। মাথা ঝুঁকিয়ে পা টেনে-টেনে
হাঁটছে। প্রতিটা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে ঘড়ঘড় আওয়াজ আসছে বুকের ভিতর থেকে।
একটা চেয়ারে
বসে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল রক্তিম, “ভয় পেয়েছ তিতির?”
“যাক,” ছোট্ট
শ্বাস ছেড়ে বলল তিতির। “তুমি সঠিক নামে ডাকলে। বাকিরা আমার আইডেন্টিটি ঘেঁটে ফেলল।“
“সবাই মিতা
বলে ডাকছে বুঝি?”
“যা বলেছ। সব
মনে হয় আবীরের বদমায়েশি। তুমি ত’ জানোই…”
“ওর আর দোষ
কোথায় বল,” বাক্যালাপের কষ্টে হাঁপিয়ে-হাঁপিয়ে বলল রক্তিম। “আমারই তালগোল পাকিয়ে গেছে
কতবার। তারমধ্যে আজকাল ডিজিটাল দুনিয়ায় উদর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া ভীষণ সোজা।
ফটোশপে মিতা সিদ্ধহস্ত। বললেই ঝট করে নামিয়ে দেবে।“
“আবার মিতা?”
রেগে গিয়ে বলল তিতির। “আমার ফেসবুক প্রোফাইল সেই বুঝি হ্যাক করেছে? চেঞ্জ করেছে ডিপি?”
“ওই ডিপি-র
ব্যাপারটা বুঝলে আমার আবদার ছিল। তোমায় বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু মিতা খবর পেয়ে গেল। অমনি
নামিয়ে ফেলল পুরো প্ল্যান। মেয়েটা আসলে তোমায় খুবই ভালোবাসে। শুধু আমার ওপরেই যত রাগ।
নাহ্ ভুল বললাম। শুধু আমি নই। আবীর-কেও সহ্য করতে পারে না।“
“রক্তিম, মিতা
বলে কেউ নেই। সুতরাং এই নিষ্ঠুর রসিকতা তোমারই মস্তিস্কপ্রসুত। ফোনে মেসেজ পাঠানো,
ছবি বদলে দেওয়া, এ’সব করে কী মজা পেলে?” চাপা গলায় জানতে চাইল তিতির। ওর শিরদাঁড়া শক্ত।
টুলের ওপরে রাখা সাঁড়াশিটা ডান হাতে তুলে পিছনে লুকিয়ে রেখেছে সে। মাঝরাতে এই ঘরে রক্তিমের
আসার কারণ ও জানে না। মনে কু ডাকছে। অনভিপ্রেত ঘটনা কিছু ঘটলে নিজেকে আত্মরক্ষার জন্যে
প্রস্তুত রাখাই শ্রেয়।
কিন্তু ওর প্রশ্নের
জবাব না দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল রক্তিম। ওর কপালের গভীর ক্ষতটা তিতির এক্ষুনি লক্ষ্য
করল। সে’খান দিয়ে ভলকে-ভলকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। মাংস খুবলে খুলির সাদা হাড়ও দেখা যাচ্ছে।
এমন ভয়ানক আঘাত নিয়েও ছেলেটা সহজ ভাবে কথা বলছে কী করে? পাগলের মত হাসছেই বা কেন?
“মিতা এই আছে
আবার এই নেই। তুমি, আমি, আমরা কেউ বুঝব কী করে?” হাসির দমক থামিয়ে বিষণ্ণ মুখে বলল
রক্তিম। “কাছে চেয়েছিলাম তোমায়। তাতেও এমন গোলমাল বাঁধালে যে সব ভোগে গেল।“
“কেন?” শুকনো
গলায় জিজ্ঞাসা করল তিতির।
“ঐযে, বাবা
আমায় নিয়ে গেল হাসপাতালে। ফিরতে পারলাম কই সে’খান থেকে।“
“ওহ্,” অস্ফুটে
বলল তিতির। বুঝল, এই জন্যেই তাহলে ভিড় জমায়েত হয়েছিল বাড়িতে। কে যেন ছাদ থেকে পড়ে গেছিল
কলতলায়। এতক্ষণ কেন মনে পড়ছিল না? মাঝে মধ্যে নিজেকে বুঝতে পারে না তিতির। সহজ স্মৃতিগুলো
খাদের ভিতরে হারিয়ে যায় পলকের মধ্যে। অনেক খুঁজেও তাদের সামনে টেনে আনতে পারে না সে।
“তোমার দোষ
নেই তিতির,” আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল রক্তিম। ধরা গলায় বলল, “মনে পড়ছে
ছাদের সিঁড়ি, ভাঙ্গা পাঁচিল? তোমায় হয়তো বেশিই জোর করতে গেছিলাম আমি। বুঝিনি কখন মিতা
চলে এসেছিল। খুব রেগে গেল সে। তারপরে …”
নিশ্চয়ই কোনও
ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছে তিতির। তাই জেগে ওঠার আশায় রক্তিমের কথা শেষ না হতেই প্রাণপণে
হাত চালাল ও। সাঁড়াশিটা হাত ফসকে সশব্দে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। চোখের সামনে ধোঁয়ার মতন
মিলিয়ে গেল রক্তিমের চেহারাটা। শূন্য ঘরে কেউ কোথাও নেই। দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনই
রয়েছে। শুধু একটা অট্টহাসি ওর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে মিশে গেল অনন্তের মাঝে। মাথায় অসহ্য
যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করতে করতে বিছানায় আছড়ে পড়ল তিতির।
শুক্রবার, ১৮ জুন, ২০২১
দূরত্ব
"হোয়াট দ্য....!"
তীক্ষ্ণ
স্বরে
বললাম আমি। অবিশ্বাসে চেয়ে রইলাম টেবিলের ওপর রাখা ট্যাবলেটটার কালো স্ক্রিনের দিকে। লো-ব্যাটারির নোটিফিকেশনটা খেয়ালই করিনি মিটিংয়ের ব্যস্ততার মধ্যে। অথচ কাল
রাতে চার্জে বসিয়েছিলাম শিওর। প্লাগে ভালো ভাবে গুঁজিনি?
চতুর্দিকে উদভ্রান্তের মতন চার্জিং কেবল খুঁজছিলাম তখনই অতনুদার ফোন এলো
নিউইয়র্ক থেকে।
"কী হল? মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে গেলি কেন? তোর প্রেজেন্টেশন শুরু করার কথা"
"আমায় পাঁচ মিনিট সময় দাও। ট্যাবলেটের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে। কেবলটাও খুঁজে
পাচ্ছি না।"
"নো গডড্যাম এক্সকিউজ রাহুল। আজ সকালেও তোকে ফোন করে মনে করিয়েছি। থ্রি
মিলিয়ন ডলারের বিজনেস ইজ অ্যাট স্টেক। তোর ফাঁকিবাজিতে
আমি ডুববো এখন।"
"বিশ্বাস করো অতনুদা। কাল রাতেই কাজ শেষ করে ক্লাউডে আপলোড করেছি। এখন আচমকা সুইচড্
অফ হয়ে গেল ট্যাব্টা। পাওয়ার কর্ডটা কোথায়
রাখলাম..."
"জয়েন কর শিগগির। সামলাচ্ছি ততক্ষণ," অতনুদা ফোন
রেখে দিল।
অতঃপর ল্যাপটপ। ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হওয়ার পরে হাই স্পিড ইন্টারনেট নিয়েছি
কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা ঢেলে। কিন্তু সে’খানেও
গন্ডগোল। ওয়াই-ফাই ডেড। ছুটলাম পাশের ঘরে। দেখলাম, মোডেমের তার খোলা।
"এ’সব
কী?" চিল্লিয়ে উঠলাম। নির্ঘাত নমিতাদি ঘর মোছার সময় এই কান্ড
করেছে।
"কী হয়েছে? রবিবারের সকালে চেঁচামেচি আরম্ভ করেছ?"
দেবযানী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলল।
"নমিতাদি-কে ছাড়িয়ে দেবে। রাউটার, মোডেম সবার তার খুলে রেখেছে। দরকারের সময় যত ঝামেলা।"
"নমিতাদি?" হেসে ফেলল দেবযানী। "মাস দেড়েক
হয়ে গেল আসছেই না। ওর বাড়িতে সবার করোনা হয়েছে ভুলে গেছ। আমরাই তো বারণ করেছি ওকে
আসতে।"
কথাটা
ঠিক। তবে তদন্তে বসার সময় নেই। মোডেমে আলো জ্বলেছে। ওয়াই-ফাই চালু হতে এখনও
মিনিট খানেক। দেরি না করে মেঝেতেই বসে পড়লাম ল্যাপটপ নিয়ে। ইথারনেট কেবল গুঁজে
দিলাম মেশিনের পিছনে। দেবযানী কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। ওর ঘাড়েও অনেক কাজ।
স্কুলের অনলাইন ক্লাসের নোট বানানো, রান্না-বান্না ইত্যাদি। আমার অফিসে এমন চাপ চলছে যে সাহায্য করবো তারও উপায় নেই।
যাইহোক, চেষ্টাচরিত্র করে
মিটিংয়ে ঢুকলাম আবার। সবার কাছে ক্ষমাটমা চেয়ে কথা বলা আরম্ভ
করতেই আবার ডিস্কানেক্টেড। এ’বারে
পাওয়ার কাট্। চাকরীটা মনে হয় গেল।
দৌড়ে
বারান্দায় গেলাম। পাশের ফ্ল্যাটে দিব্যি গম্গমিয়ে টিভি চলছে। শুধু আমারই কপাল পোড়া। কী করব এখন? আমি নিশ্চিত অতনুদা একা সামলাতে পারবে না। সিনিয়র ম্যানেজার
আশিসদাও রয়েছে কনফারেন্সে। বিরাট গন্ডগোল হয়ে যাবে। সকলের মুখে চুনকালি পড়বে আমার কারণে। ছটফটিয়ে উঠে ভাবলাম সার্কিটবোর্ডে নিজেই কারিগরী করে দেখি।
"একী!"
পুনরায় চমক। মেইন সুইচ টেনে নামানো রয়েছে। একটা টুল রাখা
রয়েছে নিচে, মেঝেতে। ঝট্ করে বুঝে গেলাম আততায়ী কে।
"বিল্টু!"
গর্জন
করতে-করতে
সারা ফ্ল্যাটে খুঁজে শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া গেল বেডরুমে, খাটের
তলায়। আমার ট্যাবলেট আর মোবাইলের চার্জার, ভিডিও-গেমের কন্ট্রোলার, টিভির রিমোট ইত্যাদি অনেক কিছু জড় করে
সে লুকিয়ে রয়েছে।
"আজকাল প্রচন্ড বাঁদরামি করছে ও," আমার রুদ্র
রূপে মা ছেলে দুজনেই গুটিয়ে গেল। "আগেরদিন আমার নতুন
মোবাইল নিচে ভাঙ্গল। আজকেও পুরো প্ল্যান করে… ভাবতে পারছ?"
"তুমি একটু শান্ত হও," দেবযানী বলল। "ও কেন
এ’সব করছে আমাদের বুঝতে হবে। আগে তো এ’রকম ছিল না।"
"নিকুচি করেছে চাইল্ড সাইকোলজির। পিছনে নিয়মিত কয়েক ঘা দিলে সব ঠিক হয়ে
যাবে," আমি ধুপ্ধাপ্ করে পাশের ঘরে চলে গেলাম। সময় কোথায়? মিটিংয়ের পরে নেটফ্লিক্স। বিকেলে
আইপিএল।
বিল্টু
চোখের জল মুছে নতুন পরিকল্পনায় বসলো। ইলেক্ট্রনিক্স
জিনিসগুলো বড্ড দুষ্টু। ট্যাবলেট, ল্যাপটপ,
মোবাইল, ভিডিও-গেম এরাই
কেড়ে নিয়েছে বাবা-কে, ওর কাছ থেকে। তবে
সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয় সেও। পরেরবার সবকটাকে একসঙ্গে
বালতির জলে চোবাবে।।