সেন্ট্রাল লন্ডনের সেন্ট জেমস পার্কের গাছে-গাছে নবপল্লবের বাহারে ছিল বসন্তের উঁকিঝুঁকি। গত কদিনের বিশ্রী, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার পরে আজকের মিঠে রোদ সবার মুখে খুশীর উষ্ণতা এনেছে। এটুকুতো ওদের প্রাপ্যই। বিগত এক বছর মহা-যুদ্ধের কালো মেঘ থাবা মেরেছে জিনিসপত্রের উপলভ্যতায়। আকাশছোঁয়া মূল্য নিত্যনৈমিত্তিক সামগ্রীকে নিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার অনেক ওপরে। আপতকালীন অবস্থার নিয়মানুসারে, নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই নামমাত্র বেতনে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে রুটির খোঁজে ব্যাকুল। সীমাহীন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতেও লোকের আহার জুটছে না আজকাল। ‘সত্যি, কি বিচিত্র এই ভাগ্যের খেলা’, কোলের ওপরে খবরের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে স্বগতোক্তি করল লোকটা। পোশাকআশাক পুরদস্তুর সাহেবি হলেও মুখের আদল আর গায়ের মাজা রঙ বলে দিচ্ছে যে সে শ্বেতাঙ্গ নয়। পকেট থেকে ঘড়ি বের করে ইতিমধ্যেই কয়েকবার সময় দেখেছে ও। অবশেষে মুখে অর্থবহ হাসির একটা ঝিলিক এনে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক বিরস বদন প্রবীণকে টুপি তুলে অভিবাদন করে গন্তব্যের দিকে পা চালাল সে।
বাকিংহ্যামের
রাজ প্রাসাদের সামনে জায়গায়-জায়গায় জটলা। একটা কিশোর কাঠের বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে
সান্ধ্য পত্রিকার খবর ঘোষণা করছে। দুষ্টু বলশেভিকদের সাথে বীর ফিনিশদের যুদ্ধবিরতি
চুক্তি হয়েছে গতকাল, আগামী সপ্তাহ থেকে দিনে দুবার করে সাইরেন বাজিয়ে বম্ব্-শেল্টারে যাওয়ার
অভ্যেস শুরু হবে এইসব আরও কত কি মুখরোচক সংবাদ। সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিনছে
ট্যাবলয়েডের কপি গুলো। লোকটা সেসব অগ্রাহ্য করে, অলিগলি বেয়ে
উপস্থিত হল লন্ডনের ঐতিহাসিক ক্যাক্সটন হলের সামনে। সিঁড়ির ধাপের কাছে কয়েক
মুহূর্ত থেমে চোখ বন্ধ করে নিজেকে গুছিয়ে নিল। একুশ বছর ধরে সে রক্তের শপথ বহন করে
চলেছে। আজ মাহেন্দ্রক্ষণে পৌঁছে কোনরকম ভীতি বা চঞ্চলতা যেন তাকে টলাতে না পারে।
কমিউনিস্ট মতাদর্শের নাস্তিকতা তাকে ‘বাহে গুরু’ বলতে বাধা দিল না। কোটের বোতাম
আটকে দৃপ্ত পদক্ষেপে মিশে গেল হলের ভিতরে আলো আঁধারিতে।
ইষ্ট
ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন থেকে আয়োজিত হয়েছে আজকের আলোচনা সভা। যেখানে খোদ ইউরোপের
মাটিতে যুদ্ধের দামামা বেজেছে,
সেখানে সুদূর ভারতবর্ষের গল্প শোনার আগ্রহ অনেকেরই নেই। শ্রোতার
উপস্থিতি অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটাই কম। তা স্বত্বেও বেশ কিছু বিশিষ্ট অভিজাত
অতিথিবর্গের আগমন হয়েছে। এঁদের অনেকেই দীর্ঘদিন ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন
গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। দূরপ্রাচ্যের
অশিক্ষিত বর্বরদের মাঝে পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোকধ্বজা তুলে ধরার জন্যে এঁরা নানা
রকমের রাজকীয় খেতাবও পেয়েছেন। লন্ডনের বুদ্ধিজীবী মহলের সেরার সেরারা আজকে চর্চা
করবেন কিভাবে যুদ্ধের পরে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও
ভারতবর্ষের ওপরে কর্তৃত্ব বজায় রাখা যায়।
খাটো ধুতির ফকির কে নিয়ে যেমন হাসির ফোয়ারা উঠছিল থেকে-থেকে, তেমনই সাদা চামড়াদের রক্ত ফুসে উঠছিল পাঞ্জাব আর বাংলার কুখ্যাত
সন্ত্রাসবাদীদের নামে। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের গর্বে তারা এতটাই মশগুল হয়েছিল যে
খেয়ালই করেনি দর্শকাসনে, দ্বিতীয় সারিতে বসা সেই বাদামী
আগন্তুককে। নিস্পলকে সে পর্যবেক্ষণ করছিল স্টেজের রাশভারী লর্ড আর ব্যারন দের
মধ্যমণিকে। বেখেয়ালে কখন হারিয়ে গেছিল স্মৃতির অতলে, একুশ
বছর আগের দিনটায়।
বৈশাখীর
মেলায় এন্তার লোক এসেছিল। বাচ্চা থেকে বুড়ো,
সকলেই হরমন্দির সাহিবে প্রার্থনা আর সরোবরে পুণ্য স্নান সেরে ঘরে
ফেরার পথে উঁকি মারতে এসেছিল মাঠের জমায়েতে। গত কয়েকদিনের নিরন্তর হিংসাত্মক ঘটনা
প্রবাহের পর সেদিন অমৃতসর ছিল শান্ত। সবাই একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে বৈশাখীর
শুভেচ্ছার আদান প্রদান করছিল। বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছিল এদিক সেদিক। মায়েরা,
দাদিরা যত্রতত্র শতরঞ্চি বিছিয়ে সাংসারিক গল্পগাছায় ছিল ডুবে। সেই
লোকারণ্যে ছিল বছর কুড়ির এক তরতাজা তরুণও। আরও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর সাথে সে মাটির
সরাতে জল দিচ্ছিল তেতেপুড়ে আসা মানুষদের। মাঠের মাঝখানে দু তিনটে কাঠের বেঞ্চি
পেতে তার ওপরে দাঁড়িয়ে দু তিনজন সত্যাগ্রহী হাতে চোঙ্গা নিয়ে ‘রাউলাট নিপাত যাও’
চিৎকার করছিল। কেউ-কেউ দাঁড়িয়ে শুনছিল তাদের কথা, আবার
অনেকেই তাদের নিজেদের সন্তানাদির দৌরাত্ম্যেই ব্যতিব্যস্ত ছিল। কানাঘুষোয় খবর
আসছিল কার্ফিউর, কিন্তু আনন্দের দিনে সামান্য একটু মুক্তির
স্বাদ নিতে পেরে সবাই সবকিছু ভুলে থাকছিল। একটা ছোট্ট ছেলেকে জল দিতে গিয়ে সেই
তরুণ লক্ষ্য করেছিল হাঁটু গেঁড়ে, বন্দুক তাক করে বসা
সেপাইদের। অতো কোলাহলের মাঝেও শ্বেতাঙ্গ অফিসারটির শ্লেষাত্মক, তীব্র ‘ফায়ার’ আদেশ কানের পর্দায় অনুরণিত হয়েছিল তার। কিছু বোঝার আগেই
চোখের সামনে পিপাসার্ত ছেলেটির বুক চিড়ে ছুটে গেছিল বুলেট। সেই অবাক হাঁ করা মুখে
জলের ফোঁটা দেওয়ার সুযোগও পায়নি তরুণটি। কাঁধে গুলি খেয়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল তার
দুই চোখে।
‘আপনাদের সামনে এবারে বক্তব্য রাখবেন সম্মানীয় মাইকেল ও’ডায়ার, পাঞ্জাবের গভর্নর ছিলেন ইনি। বদমাশ নেটিভ দের শায়েস্তা কি করে করতে হয় তা এনার কাছ থেকে শেখা উচিত’, বক্তা আহ্বান করলেন প্রধান অতিথিকে কিছু বলার জন্যে।
গলা
খাঁকারি দিয়ে কিছু বলার সময় বক্তার চোখ আটকে গেল সেই বাদামী শ্রোতার দিকে। জহুরীর
চোখ, সহজেই
রঙের পার্থক্য করা শিখেছেন দীর্ঘদিনের অভ্যাসে।
‘এই ভারতীয় এখানে কি করছে?’
স্মিত
হেসে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে পিস্তল তাক করলো সেদিনের সেই তরুণ। একুশ বছরের অপেক্ষার
শেষে মাতৃভূমির রক্তের ঋণ শোধ করবে আজকে রাম মহম্মদ সিং আজাদ ওরফে বিপ্লবী উধম সিং,
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান