রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২১

আমার খেলা যখন


পুরনো খড়খড়ি নামাতেই একটা তীক্ষ্ণ সোনালি ছটা ঝর্ণার গালে এসে পড়ল। আশিস ঝর্ণার থুতনি ছুঁয়ে ওর মুখ তুলে ধরল আলোতে। চোখের কোণে হীরের মতন চিকচিক করে ওঠা জলের ফোঁটা দুটো তাকে অনুভব করাল দুখী মেয়েটার অভিমানের ভার।

“আষাঢ় মেঘে রাখল ঢাকি, নাম যে তোমার কাজল আঁখি”, আশিস কাব্যি করে তর্জনী দিয়ে মুছে দিল অশ্রুবিন্দু। প্রেয়সীকে আরও নিবিড় করে দেখার আশায় জানালার পাল্লা খোলার জন্যে সে খুবই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। একতলায় সিঁড়ির ধারে জীর্ণ আসবাব ডাই করে রাখার ঘরটিতে ঝর্না আর হরুদাদা ছাড়া কারোরই পা রাখার সময় বা কারণ হয়না। পরিচর্যার অভাবে মরচে ধরা ছিটকিনি সশব্দে আপত্তি জানানো ব্যতীত আশিসের প্রয়াসে নির্বিকারই থাকল।

“তুমি পাগল হলে? লোকে জেনে যাবে তো”, ঝর্না তড়িঘড়ি আশিস কে নিবৃত্ত করল।

“কার এতো বড় সাহস রাজপ্রাসাদে উঁকি দেবে? দারোগা কাকু খুলি উড়িয়ে দেবে না?”, আলোআঁধারির মাঝে আশিসের কৌতুক উপেক্ষা করল ঝর্না। বদ্ধ ঘরে বাক্স প্যাঁটরার আড়ালে গত একমাস জীয়ন কাঠির মতন আগলে লুকিয়ে রেখেছে এই দাবানলের স্ফুলিঙ্গ কে। কি করে বোঝায়, তাকে হারানোর দুঃস্বপ্ন অহরাত্রি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তরুণীর ক্ষুদ্র প্রাণটাকে।  বিপ্লবের গভীর তত্ত্বকথা তার মাথায় ঢোকে না। হ্যারিকেনের কাঁপা আলোয় আশিসদা যখন পৃথিবীকে বদলাতে চায়, ঝর্নার বুকের ধুকপুকানি তখন দেওয়াল জোড়া ছায়াময় যুবকটিকে একান্ত আপন করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ভারি রাগ হয় তার, শ্রেণীশত্রু, বুর্জোয়া এসব গুরুপাক শব্দ না বলে আশিসদা যদি কখনও একসাথে তারাখসা দেখার গল্প করত।

“আর মামাবাবু জানতে পারলে?”, আশিসের বুকে মাথা রেখেও স্বরের ব্যাকুলতা লুকোতে পারল না ঝর্না।

“ধুর পাগলি। এই পেল্লাই বাড়ির কোন কোনায় কে ইঁদুর বাদুর লুকিয়ে রেখেছে, সব খবর রাখার কি সময় আছে তাঁর। আর যদি জেনেই যান, তাহলে বলবেন হ্যান্ডস আপ। আর আমিও বই খাতা বগলে নিয়ে সোজা গারদে ঢুকব”, বুকের হাহাকার ঢোঁক গিলে চাপল আশিস। লালবাজার থেকে ওর নামে শুট অ্যাট সাইট হুকুমনামা জারি হয়েছে। ঝর্ণার মামাবাবু জাঁদরেল মন্ত্রী। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বোন আর ভাগ্নি কে ঠাই দিয়েছেন এখানে। তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি স্বরূপ এদের পুনরায় গৃহহীন না করেন। বড় ভুল হয়ে গেছে আশিসের, স্বার্থপরের মতন এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে  বিপদে ফেলেছে সে আশ্রয় চেয়ে। আগামীকাল কাকভোরেই সে রওনা দেবে এখান থেকে। পুলিশের টিকটিকি গুলোর ওই সময় চোখ লেগে আসে।

“এই দেখো চেয়ারম্যান কি বলছে”, ঝর্না কে পাশে সরিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল আশিস। সামনের টেবিলে বই খাতা ছড়ানো। শ্রেণীসংগ্রাম নিয়ে নোট লিখছিল সে আধো অন্ধকারে। বন্দুকের নলে বিশ্বাস রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানিং। ঝর্ণাকে পার্টির বক্তব্য বোঝাতে গিয়ে আজ নিজেই সে সন্দিহান। সাধারণ মেয়ের সাদামাঠা পাল্টা প্রশ্নগুলো আশিসকে দ্বন্দে ফেলে দিয়েছে। ইস্তাহার ঘেঁটে হয়রান হয়ে গিয়েও অকারণ খুনোখুনির যথার্থতা খুঁজে পায়নি সে।

“আমার কি হবে আশিসদা?”, কাঁধ ঘেঁসে দাঁড়ানো ঝর্ণার জিজ্ঞাসায় থামল আশিস। একি সর্বনাশ করেছে সে মেয়েটার? হাতের কলম ফেলে অসহায়ের মতন ও তাকাল তার দিকে। দৃষ্টি সংযোগে মাথা নামিয়ে নিল ঝর্না। আগুন পথের সন্ন্যাসীকে বাহুডোরে বেঁধে রাখার ক্ষমতা তার নেই। আশিসদার লড়াই বৃহত্তরের মঙ্গলের স্বার্থে, সেখানে এক যৎসামান্য, অবুঝ তরুণীর কিই বা ভূমিকা থাকতে পারে।

“তক্তপোষে রুটি রেখেছি, খেয়ে নিও। হরুদাদা পরে থালা নিয়ে যাবে”, মৃদু হাসিতে আশিস কে আস্বস্ত করে, তার পায়ের ধুলো নিয়ে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল সে।

“মামাবাবু, ওর যেন কোন ক্ষতি না হয়”, ধুমায়িত চায়ের পেয়ালার পাশে বদ্ধ ঘরের চাবি রেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের ঘরে ঢুকে কপাট দিল ঝর্না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান