রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২১

একলা জ্বলো রে


 ফিস কবিরাজির টুকরো চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিবানোর পর বিশ্ব হঠাৎ করে টেবিলে এক ঘুষি মেরে বলে উঠল, ‘অবনক্সিয়াস ইডিয়টস! রাসকেল গুলোর সাহস হয় কি করে, স্টুডেন্টদের ইগ্‌নোর করার?’

টেবিলের ঝাঁকুনিতে চলকে পড়া কফির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাম্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বিশ্ব যখন বলেছে তখন নিশ্চয়ই সত্যি হবে। ও এই সব ব্যাপার অনেক বোঝে। কয়েকমাস পরেই কলেজ ইউনিয়নের ইলেকশন। বিশ্ব দাঁড়িয়েছে ইলেকশনে। ওর চেহারার চাকচিক্য আর জ্বালাময়ী ভাষণ দেওয়ার ক্ষমতা ওকে ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে এগিয়ে রেখেছে বহুদূর। বিশ্ব খুবই জনপ্রিয় ছাত্র। মেয়েরা ওর সান্নিধ্যে আসার জন্যে পাগল। মাঝেমধ্যে খুব ঈর্ষা হয় সাম্যর। ছেলেবেলা থেকেই হয়। বিশ্বর এই এক্সট্রা কারিকুলার গুণাবলীর কণামাত্র যদি সে পেত, তাহলে জীবনটা ধন্য হয়ে যেত। চিরকাল সাম্য পাঠ্য বইয়ের পাতাতেই মুখ গুঁজে বড় হয়েছে। স্টেজে ওঠার কথা শুনলে এখনও পা কাঁপে। সেখানে বিশ্ব অবলীলায় গিটার অথবা হারমোনিকা নিয়ে হয়ে যেতে পারে সকলের মধ্যমণি। মাথার ঝাঁকড়া চুল নাড়িয়ে, সুরের ঝঙ্কারে মাতিয়ে তুলতে পারে সবাইকে। ভিড়ের মাঝে, এককোণে দাঁড়িয়ে তার এই অসামান্য ক্ষমতার প্রশংসা করা ছাড়া আর কিই বা করতে পারে সাম্য। কতদিন মনের কল্পনায় নিজেকে দেখেছে সাম্য, হাজার-হাজার ছাত্রছাত্রী দের নেতৃত্ব দিয়ে মিছিল নিয়ে যেতে কলেজ ষ্ট্রীট ধরে, যেমন বিশ্ব পারে। হাজার উদ্বাহু প্রাণকে সে অনায়াসে সঞ্চালন করছে জাদুকরের মতন, বিশ্ব যেভাবে করে। দিবাস্বপ্নেই আতঙ্কে ঘেমে উঠেছে সাম্য। ওর ছাপোষা মেরুদণ্ড সেখানেও এতোটা জোর নিতে পারে না।

‘কাল দুপুর থেকেই ইউনিয়ন স্ট্রাইকে যাচ্ছে। প্রফেসর পি.কে.এমের ক্লাসের পরেই তোরা সবাই বেরিয়ে দু’নম্বর গেটের সামনে জমায়েত হবি। সেখান থেকে প্রসেশন করে আমরা প্রিন্সিপ্যালের কাছে যাব। আমাদের দাবী না মানলে পরশু থেকে সব ক্লাস বয়কট’, বিশ্ব একটা টিসু পেপারের ওপরে পেন দিয়ে আঁকিবুঁকি কেটে ওর ছাত্র আন্দলনের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিল সাম্য সহ উপস্থিত আরও তিন-চার জন কে। বাকিরাও সবাই লিডার গোছের, লড়াকু মনভাব আছে তাদের। একমাত্র সাম্যই এখানে বেমানান। বিশ্ব ওর ছোটবেলার বন্ধু, সাম্যকে বলতে গেলে জোর করেই নিয়ে এসেছে আজ কফি হাউসের আড্ডাতে।

কিন্তু নিজের অস্বস্তি গোপন রাখতে পারলো না সাম্য এইবার। নিজেকে গুটিয়ে রাখার অনেক চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে বেফাস বলেই ফেলল, ‘আবার স্ট্রাইক? গত মাসেই তো কতগুলো ক্লাস মিস হল। পরশু থেকে কিছু মেকআপ সেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল’।

‘ডোন্ট বি সাচ আ কাওয়ার্‌ড সাম্য! এ’রম মেকআপ ক্লাস আসবে যাবে। এর কথা ভেবে যদি আমরা আজকে অন্যায় মেনে নি, তাহলে আর কোনোদিন মাথা তোলার রাইট থাকবে না আমাদের’, বন্ধুকে কোন ছাড় দিল না বিশ্ব, কথা শোনাতে। এই ভীতু মানসিকতার ছেলেমেয়ে দের জন্যেই পৃথিবীতে ছাত্র বিক্ষোভ বারবার অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে গেছে।

‘নেক্সট উইক আমরা কোথায় আমেরিকান সেন্টারের সামনে ধর্না দেওয়ার প্ল্যান করছি আর তুই তোর ক্লাস নিয়ে পড়ে আছিস বোকা কোথাকার!’

সমষ্টির হই-হই এর মাঝে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল সাম্য। বিশ্বর বাবা এক নামকরা মিডিয়া হাউসের চেয়ারম্যান। চোস্ত ইংরাজি বলা বিশ্ব, কলেজ শেষ করে বিপ্লব-বিপ্লব খেলবে হয়ত আরও কিছুদিন। তারপরে একঘেয়ে লাগলে বাবার ব্যবসায় হাত লাগাবে। কাপুরুষ সাম্যটাই শুধু ক্লাস মিস করা গ্লানিতে জুতোর সুকতলা ছিঁড়বে।

‘নন্দনে যাবি? ওখানে বোহেমিয়ান মিউজিক ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে’, বন্ধুকে কড়া কথা শোনানোর জন্যে বিশ্ব একটু অনুতপ্ত হয়ে প্রস্তাব দিল।

‘নাহ আমার টিউশন করাতে যেতে হবে।’

‘পরমা আসবে বলেছে। তাও যাবি না? পাগলে গেলি নাকি?’   

‘নাহ্‌ রে স্টুডেন্ট টার সামনেই পরীক্ষা। একটু দেখিয়ে না দিলে বিপদে পড়বে। তুই এগো ভাই, আরেকদিন হবে।’

বই পাড়া ধরে হাঁটতে-হাঁটতে নিজেকে খুব নগণ্য মনে হচ্ছিল সাম্যর। অনেকটা বইয়ের স্তুপে হারিয়ে যাওয়া পুরনো ম্যাগাজিনের মতন, যার খবর কেউ রাখে না। যে হারিয়ে গেলে কারোর কিছু যায় আসে না। বই এর বান্ডিল গুলোর মতনই যূথবদ্ধ একদল অতি সাধারণ মানুষের একজন সে। রিভলিউশন, গিটার, সামাজিক পরিবর্তন, আন্দোলন এইসব হৃদয় দোলানো, রক্ত টগবগিয়ে তোলা জিনিস ছেড়ে রেখে, বাবার পেনশন আর বোনের স্কুলের মাইনের মতন গতানুগতিক বিষয় নিয়ে তাকে দিন কাটাতে হয়। রাস্তার পাশের ডাস্টবিন টাকে নিজেকে কল্পনা করে একদলা থুতু ছিটিয়ে বাসে উঠে পড়ল সাম্য।

বাসের জানালা দিয়ে ধোঁয়াশায় ঘেরা চলমান জনতা কে নিজের মনে করুণা করছিল সাম্য। কি ক্ষুদ্র, কি সামান্যই না ওদের জীবনের লক্ষ্য। নিত্যনৈমিত্তিক ভাত-রুটির খোঁজে ব্যস্ত থাকা লোক গুলো জানতেই পারেনা গোটা দুনিয়ায় কি আলোড়ন হচ্ছে। প্যারিসে হলুদ শার্টরা ব্যারিকেড ভেঙ্গে সমতার গান গাইছে। আফ্রিকার গরীব গুলো এখনও না খেতে পেয়ে মরছে। মেরুর বরফ গলে কদিনের মধ্যেই সব ফর্সা হয়ে যাবে। জাপানে মাছ খেয়ে লোকেরা একশ বছর বাঁচছে। ‘খ্যাক থুঃ’, কিস্‌সু জানে না এরা। খালি ট্যাক্স বাঁচানোর ফন্দি ফিকির খুঁজে বেড়ায় আর জীবনভর গাধার মতন এলআইসি প্রিমিয়াম ভরতে থাকে।

একটা চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে বাসের পিছনের দিকে তাকাল সাম্য। দেখল তিন চারটে পাকানো চেহারার  ছেলে একজোট হয়ে কুৎসিত ভাষায় ঠাট্টা পরিহাস করছে। ওদের লক্ষ্য সামনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা এক যুবতী। ছেলেগুলোর বেপরোয়া, নোংরা, ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা আর লুড দৃষ্টি অসহায় মেয়েটাকে টিকতে দিচ্ছে না নিজের সিটে। বাস ভর্তি লোক, কিন্তু তারা সবাই আজ বিবাগী হয়ে জানালা দিয়ে দূরের কোন দৃশ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে। বাসের ভিতরে ভয়ে ছটফট করতে থাকা মেয়েটাকে কেউ যেন দেখতেই পাচ্ছে না। সবার এই আন্তরিক নীরবতায় বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠতর হয়ে উঠল ছেলেগুলো। ওদের একজনের হাত এরপরে ইচ্ছে করেই ছুঁয়ে দিল তার শিকার কে। মেয়েটার ফোঁপানো আর্তনাদ বাসের ইঞ্জিনের ঘর্ঘর শব্দের থেকেও জোরালো হয়ে কানে বিঁধল সাম্যর।

কি করত বিশ্ব, যদি সে এখানে থাকতো? নিশ্চয়ই ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি চেপে ধরত ওই দুষ্কৃতি গুলোর। ওর বেয়াম করা পেশীবহুল হাতের এক ধাক্কায় নির্ঘাত নড়ে যেত ওদের ঘিলু। ওর অদম্য সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাকিরাও উঠে প্রতিবাদ করত। কিন্তু বিশ্ব তো কোনদিন বাসেই চড়েনি। ওর লাখ টাকার বাইক প্রতিদিনই হুস করে পাশ কাটিয়ে চলে যায় সাম্যদের ভাঙ্গাচোড়া বাস। আজও সে জানতেই পারবে না তার নেতৃত্বের কতখানি দরকার এখানে, এই মুহূর্তে। ভেনিজুয়েলার লোকেরা নাহয় ওর জন্যে অপেক্ষা করত আরেকটা দিন।


‘কাওয়ার্‌ড’, শব্দটা বার বার কানে বাজতে লাগলো সাম্যর। বিশ্ব শুধু ওটা সাম্যকে বলেনি। শালা এই পুরো জাত টাই কাপুরুষে ভরা। পঞ্চাশটা লোক কেমন মাথা নিচু করে নিরাপদে ঘরে পৌছাতে চাইছে। বাড়ি গিয়ে, ডাল-রুটি খেয়ে, জমিয়ে সারেগামাপা দেখে আবার পরের দিনের লড়াই শুরু করবে এরা। নিজের মাছভাজা, শুক্ত খাওয়া সরু লিকলিকে হাত দুটোর ওপরে ঘেন্না এলেও সাম্যর ভরসা আছে তার কল্‌জের ওপরে। মেয়েটাকে নয়, খোলসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাকি লোকগুলোকে বিশ্বর ‘কাপুরুষ’ গালির হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে কিছু করা উচিত। এঁদের দরকার পথ-প্রদর্শকের, যে অনেকটা তাদেরই মতন নিরীহ, গোবেচারা।

ব্যাগটাকে শান্ত ভাবে সিটে রেখে উঠে দাঁড়াল সাম্য। কয়েকটা বিস্ফারিত চোখের সামনে দিয়ে দৃপ্ত কিন্তু ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ওদের কাছে। তারপরে বুকের সবটুকু দম একত্রীত করে চিৎকার করে বলল, ‘খবর্দার!’

ছেলেগুলো চমকে দেখল সাম্য একা নেই সেখানে, উঠে দাঁড়িয়েছে আরও অনেক মধ্যবিত্ত।।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান