‘স্যার, আমার ছবি খুঁজে পাচ্ছি না’।
অভিজিত কাজ
থেকে চোখ তুলে তাকালেন। শ্যামলা, ছোট-খাট গড়নের ছেলেটা ছলছল চোখে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে।
ওর নাম শঙ্কর। পদবী মনে পড়ল না। দিন সাতেক আগে প্রথম দেখেছিলেন বোধহয়। এবারে তিনি নিজের
ছবির সাথে কিছু নতুন শিল্পীর আঁকা নিয়ে প্রদর্শনী করছেন। নতুন প্রতিভা দের নির্বাচন
করেছেন রিয়্যালিটি শো এর মাধ্যমে। গোটা রাজ্যে রীতিমত সাড়া পড়ে গেছিল। অভিজিতের ছবি
লন্ডনের ফাইন আর্টস মিউজিয়ামের শোভা বর্ধন করছে। এহেন প্রথিতযশা চিত্রকরের সৃষ্টি সমূহের
সাথে এক্সিবিশন রুম ভাগ করে নেওয়ার সৌভাগ্য লাভের আশায় অনেকেই হাজির হয়েছিল। ঝাড়াই
বাছাই করে তাদের মধ্যে থেকে তিন জনের ছবি পছন্দ করেছেন অভিজিত। না, শঙ্কর তাদের মধ্যে
ছিল না। ওকে তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিল রুমেলা। বারবার অনুরোধ করেছিল প্রতিভাধর গরীব ছেলেটিকে
সুযোগ দেওয়ার জন্যে। অভিজিত, প্রিয় ছাত্রী সুন্দরী রুমেলার কথা ফেলতে চাননি। শঙ্করের
পোর্টফলিও তে একবার চোখ বুলিয়েই আলগোছে একটা ছবির দিকে তর্জনী তুলেছিলেন। কি ছিল তাতে?
নাহ্, মনে পড়ছে না। কিন্তু একাডেমী থেকে চুরির অভিযোগ সহজ কথা নয়।
খুব বিরক্ত
হয়ে আসন ছেড়ে উঠলেন অভিজিত। কিছুক্ষণ আগেই, পথশিশু দের ওপরে বানানো তাঁর ‘ফিনিক্স অফ
বেঙ্গল’ ছবি টা পঁচিশ লক্ষ টাকার চেক দিয়ে বুকিং করে গেলেন ভারতের বিখ্যাত ইন্ডাস্ট্রি
হাউসের মালকিন অলকা জালান। গত দু’দিনে এ’রকম আরও ছ’টা কাজ বিক্রি হয়েছে। প্রদর্শনীর
প্রবেশ মূল্যই যেখানে কয়েক হাজার টাকার ওপরে সেখানে সাধারণ চোর ছ্যাঁচোড় তো আসবেই না।
‘আপনার ছবির
গুনতি সব ঠিক আছে স্যার’, ইভেন্ট ম্যানেজার তমাল হন্তদন্ত হয়ে এসে খবর দিল। অভিজিতের
ছবি এদিক থেকে ওদিক হলে এখুনি বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে। পুলিশ তো জড়াবেই, এমনকি সিবিআই
ও ঢুঁ মারতে পারে।
‘কোথায় ছিল
তোমার মোনালিসা?’, অভিজিত প্রশ্নে তাচ্ছিল্যের ভাব লুকালেন না।
‘এই যে স্যার,
এদিকে’, শঙ্কর অর্ধ-বৃত্তাকার ঘরটির বাম হাতের সীমানার কাছে এগিয়ে গেল। এখানেই দেওয়ালে
টাঙ্গানো রয়েছে অভিজিত রায়ের এখনও পর্যন্ত সেরা কাজ, ‘ইমারশন’। পিছনে দক্ষিনেশ্বরের
কালি মন্দির কে রেখে হুগলী নদীতে প্রতিমা ভাসানের এক অদ্ভুত সুন্দর তেল চিত্র। তিনি
নিজেই আবার মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
‘এখানে টাঙ্গানো
ছিল স্যার’।
অভিজিতের ছবি
যেখানে শেষ হয়েছে তার পাশে একটা ছোট দেওয়ালে অপেক্ষাকৃত অবহেলায় নতুন শিল্পীদের আঁকা
গুলো রয়েছে। তাদের মাঝখানেই শঙ্করের টাও ছিল। সব অ্যামেচার ব্রাশে ওয়ার্কের পাশে অভিজিতের
ছবি, যেন ধারাভির বস্তিকে হেলায় ফেলে মাথা উঁচিয়ে থাকা অম্বানির প্রাসাদ। এই ছবির দাম
অন্তত এক কোটি তো হওয়াই উচিত।
আবার শঙ্করের
দিকে তাকালেন অভিজিত। ছেলেটার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। নিজের অসম্ভব পরিশ্রমের ফল কে এভাবে
হারিয়ে যেতে দেখলে মন খারাপ তো হবেই।
‘শোনো, এত ভেঙ্গে
পড়ো না। অভিজিত রায়ের এতগুলো ছবি ফেলে চোর যে শুধু তোমার টা নিয়ে গেছে, সেটাই অনেক
বড় সম্মান’, শঙ্করের কাঁধে হাত রেখে তমাল বলল, ‘আঁকতে থাকো। স্যার তোমাকে আরও সুযোগ
দেবেন ভবিষ্যতে’।
শঙ্করের মাথার
চুল ঘেঁটে দিয়ে রিসেপশন ডেস্কে ফেরত এলেন অভিজিত। কপালে তাঁর বিন্দু-বিন্দু ঘাম। দিনের
শুরুর ঘটনা গুলো মনে পড়ল। তমাল সাত সকালেই একাডেমী থেকে ফোন করে খবর দিয়েছিল। বিখ্যাত
শিল্প বোদ্ধা স্যার গ্রেগরি রবিনসন, সারা বিশ্ব যার মূল্যায়ন এক কথায় মেনে নেয়, তিনি
গতকাল প্রদর্শনীর একটা নতুন ছবির দাম ঠিক করেছেন প্রায় দু কোটি। অচেনা কুঁড়ের দেউটি তে খেলতে থাকা শিশুদের নিয়ে আঁকা
সেই আনকোরা আলেখ্য ম্লান করে দিয়েছে নাকি বাকি সব কিছুকে।
ছবিটাকে গোপনে
সরিয়ে, ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার পরামর্শ তমাল কে অভিজিত রায়ই দিয়েছিলেন।।
মাৎসন্যায় সব যুগে সবসময় ই ছিল।ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন