রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২১

গঙ্গারাম

 ভূমিকাঃ গঙ্গারাম গল্পটি লিখেছিলাম এপ্রিল ২০২০তে। রম্য রচনায় এটা আমার প্রথম প্রয়াস। আশা করি খুব একটা খারাপ লাগবে না। ছবি - আমার আঁকা।


মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ কি? তা এই প্রশ্নটি আমাকে না করে মোগল দের কোন ভায়রা ভাই কে করলে ভাল হত না কি? তাদের কাছেই এইসব কানাঘুষো খবর বেশি থাকে। এই যেমন আমি জোগাড় করেছি বিষ্টু মুকুজ্জের পাতাল প্রবেশের ‘বিকজ’। তেনাদের বিড়ির ব্যবসা ছিল একেবারে জমে ক্ষীর টাইপের। সকাল দুপুর বিষ্টু ভটভটিয়ে ঘুরে বেড়াত কলার তুলে। তারপর একদিন সব ফর্সা। কাক পক্ষীটিও টের পেল না বিষ্টু কই গেল। বিষ্টুর মা সবাইকে বলে বেড়ালো বিষ্টু নাকি হিল্লি দিল্লী ঘুরে বেড়াচ্ছে বিড়ির বিজনেসে। আমি শুনেই বুঝেছিলাম, শালা সব ঢপ। ওই বিড়ি মোটেই খেতে ভালো না, কেমন তিতকুটে সাদ, দাঁত টকে যায়। এরপর সেই দোলের দিন, বিষ্টুর ছোট শালির বর গোবরাটাকে দু’পাত্তর দিয়ে চেপে ধরতেই বাপু গলগল করে সব আউড়ে দিলেন। বিষ্টু নাকি বিড়ির মধ্যে পাতা পুরে বেচে কলাগাছ হয়েছে। হু হু বাপ, যেমন তেমন পাতা নয়কো, এক্কেবারে শিব ঠাকুরের ফেবারিট পাতা। শেয়ালদা ইষ্টিসনে রেল পুলিস খপ করে ধরে ঢুকিয়ে দিয়েছে ভিতরে। আর আমায় কি না দিল্লী দেখাচ্চে! বেশি বাড় বাড়লে পতন তো হবেই। ছিলি ভালো, আমতলার হাটে বস্তা পেতে বসতিস। সুখে থাকতে কি ভূতে কিলিয়েছিল যে সোজা শেয়ালদা যাবি? কেউ আমাকে বিষ্টু মুকুজ্জের পতনের কারণ জিজ্ঞাসা করেই দেখুক না, তিন ঘণ্টার কেলাস যদি না নিয়েছি তো আমার নাম গঙ্গারাম নয়। সেসব কাজের জিনিস পুছতাছ না করে মোগলদের হেনাতেনা এই সব নিয়ে মদনবাবু দিনের পর দিন ঘেমো হাতে অকারণে সক্কলকে বেতিয়ে বেড়িয়েছেন। না মানে সক্কলকে নয়। দু’একটা অখাদ্য, অমানুষ, বেয়াক্কেলে চ্যাংড়া, যারা দিন রাত এক করে ওই আকবর না বাবরের ঠিকুজি নিজেদের মাথায় ফুটো করে ঢোকানোর চেষ্টা করে গেছে, তাদেরকে বাদ দিয়ে, এই আমার মতন জোয়ান মদ্দ ছেলেদের।  

বলি পানিপথের মাঠ নিয়ে কার কার মধ্যে লোচা হয়েচিল সেটা জেনে কার বাবা বড়লোক হয়েছে শুনি? তাও সেটা নিয়ে এতো জিজ্ঞাসা। অথচ ও’পাড়ায় কাকপোতার ডোবা নিয়ে বাওয়ালটা কজনের মনে আছে সন্দেহ। কোথায় লাগে পানিপথ তার কাছে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজের মধ্যে দিন রাত্তির সেকি ফাটাফাটি। পেটো পড়ছে তো পড়ছেই। তুবড়িদা’র জমিয়ে কদর তখন। আজ লালের হয়ে নীলকে চমকাচ্ছে তো কাল সবুজের হয়ে হলুদকে। হাতের পেলাসটিকের ব্যাগ ভর্তি পেটো আর কোমরে দুই জোড়া ওস্তাদ নিয়ে তুবড়িদা কাকপোতার ডোবায় মাটি ফেলত। আমি একবার বলতে গেছিলুম, পেলাসটিক ব্যভারটা ঠিক নয়। এনভাওরনের ক্ষতি করে। আমাকে দু’লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দিলে। কিন্তু ওপরওয়ালা এই অবিচার ঠিক লক্ষ করেছেন। কাকপোতার কত নম্বর যুদ্ধে জানি না, পেলাসটিক ছিঁড়ে পেটোগুলো পড়ল তুবড়িদা’র পায়ের কাছে। মার এখন কাকে লাথি মারবি? অকারণে এতো লড়াই করলে পতন হবে না? গান্ধিজি বলে যায়নি? পেটোর বদলে পেটো মারলে একদিন কারোর কাছে পেটো রইবে না। রংবাহারের দল মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিল বলেই না আজকে কেমন রামধনু রঙের আখাম্বা বাড়িগুলো হয়েছে কাকপোতায়। এতো হেজিয়ে পেজিয়ে পাতার পর পাতা বই পড়ার পরে মোদ্দা কথা হল, অকারণে পাঙ্গা নিস না। সেটা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেই বলে দিতুম, বেকার বেকার মদনবাবুকে কেলাসে বসে লাঠি ঘোরাতে হত না।

শুধু কি এই? মোগল হোদলাগুলো তিরিশ চল্লিশটা করে রানি পুষেছে ঘরের মধ্যে। আমি ভাবি, পাগল না পেঁয়াজি? দিলুর বাপ রোজ হালকা নেশা করে বাড়ি ঢুকে একটি বউয়ের কাছেই আগাগোড়া ঝাঁটা পেটা খায়। তারপরে বাইরে বসে মন খারাপ মার্কা হেচকি তোলে। কত বড় লোক সে। বিরিজের তলায় একটা চোলাই ঠেক চালায়। মেলা কাজ। কি টেনসন আর কি টেনসন। মানুষের লাইপ নিয়ে খেলা যাকে বলে, কিন্তু কোনো সম্মান নেই ঘরে। আমি একবার তার শুঁড়ির কারখানায় উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে একটা ফেনলের শিশি উলটে দিয়েছিলুম হাঁড়িতে। কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ কেটে পড়েছিলুম বাবা সেখান থেকে। ফেনলের জন্যে যদি দু’টাকা চেয়ে বসে? পরের দিন শুনি পোঁদপাড়ার লোকেরা এসে বেদম ঠেঙিয়েছে দিলুর বাপকে। চোলাই খেয়ে কটা বুড়ো খুশির চোটে অক্কা পেয়েছে। লাইপ অ্যান ডেথ ব্যাপার নাতো কি? এ’রকম টেনসনে থাকলে দেখতাম সেলিম কেমন ফুল নিয়ে দৌড়ায় আনারকলির পিছনে। আর ওই রকম উদমা মুড়ো ঝাঁটায় সপাং সপাং খাওয়ার পর কোন পুরুষ মানুষের তাজ হোটেলে বউকে ফিসটি দেওয়ার সখ বেঁচে থাকে? সেই দুঃখেই তো শাজান স্যার কেঁদে কেটে মরে গেল। ইস্কুলের নাটকে দেখেছি। হেব্বি হাততালি পড়েছিল। দিলুর বাপের চোখে জল চলে এসেছিল আমি দিব্যি কেটে বলতে পারি। 

বিয়ে আমার এখনও হয়নি বটে কিন্তু ব্যাটাছেলের দুঃখ আমি ঠিক বুঝি। আক্কাস গাজির চার নম্বর নিকা তে গিয়ে আমি ওর কানে কানে বলেছিলুম, এতো কচি বউ, পালাবে কিন্তু। ওমা সেকি রাগ! দাঙ্গা প্রায় বাঁধে বাঁধে। মাস ছ’য়েকের মধ্যে চার বউতে এমন চুলোচুলি করলো যে আক্কাস গাজি নিজেই পালিয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে। অদ্ধেক হলেও আমার কথা ফলল তো?  ভেবে দেখ, চারেতেই আক্কাস গাজির মতন পালোয়ানের যদি এই হাল হয়, তালে ওই মোগলের ব্যাটারা চল্লিশ বউ নিয়ে আছাড় খাবে না? পতনের কারণ কি এর পরেও চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে দিতে হবে? 

তাও জিজ্ঞেস যখন করেইছ আমিও উত্তর না দিয়ে যাবই না। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েই ছাড়ব। ওমা, দেখচি কলমে কালিই নেই। সামনের ছোঁড়াটার জামায় নিব লাগিয়ে বসে ছিলাম। সব কালি এখন ওর পিঠে।  পাশের ঘণ্টু কি এতো লিখছে কে জানে। অনেক চাইতেও হারামজাদা কলম ধার দিল না। মন বড় না হলে কোনোদিন নম্বর পাবে না হতভাগা, বলে দিলাম আমি। কিন্তু এ আবার কি? এই লোকটা আমার খাতা নিয়ে যাচ্ছে কেন?

“পিসেমশাই, থুড়ি মাস্টারমশাই, আমার খাতা দিয়ে দিন বলছি! একটা কোয়েসচেন কমন পেয়েছি অনেক বছর পর। লিখেই বেরিয়ে যাব।”

আমার কথা কানেই তুললে না? আস্পদ্দা কম নয় বুড়োর। গলাটা চড়াতে হবে এইবার।

“পিসেমশাই…”, মোলো যা। খালি পিসোকে নিয়ে টানাটানি কেন করছি কে জানে। “মাস্টারমশাই  আমার খাতা…”

এইও আরও লোক নিয়ে আসছে কেন রে বাবা? দাঁড়া ঝোলা থেকে বের করছি পেটোগুলো। 

মধ্যশিক্ষা পর্ষদ থেকে জানা গেছে যে মাধ্যমিক পরিক্ষা নির্বিঘ্নে হয়েছে। কেবল একটি জায়গার খবর পাওয়া যাচ্ছে না। উপগ্রহ থেকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা চলছে। বিস্তারিত খবরে পরে আসছি…

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান