তালপুকুরে পা ডুবিয়ে বসে ছিল অনিক। হ্যাঁ, তালপুকুরই হবে, কেননা চারদিকে অনেক লম্বা-লম্বা তাল গাছ। জামরুল আর কাঁঠাল গাছও আছে যদিও। কিন্তু অনিকের তালপুকুর নামটাই বেশি ভালো লাগে। মাছগুলো বেশ আলাপি, দল বেঁধে অনিকের পায়ের আঙ্গুল ঠুকরে দিচ্ছে। সুড়সুড়িতে অনিক খিলখিল করে হাসছে। এরকম মজার মাছ ও আগে কোনোদিন দেখেনি, ধরা পড়ার কোন ভয়ই নেই ওদের। একমাথা রোদ নিয়ে শান বাঁধানো ঘাটে বসে আছে অনিক। রোদ এত ঝলমলে, কিন্তু গায়েই লাগছে না। একেই মিঠে রোদ বলে বোধহয়। তবে তালপুকুরের ব্যাপারটাই আলাদা। এখানে সকলে অনিক কে বোঝে আর অনিকও ওদের সব গুঞ্জন শুনতে পায়। ঝিকমিক করা ছোট ঢেউ বা ভাসতে থাকা পাতা প্রত্যেকেরই একটা নিজস্ব ওয়েভলেন্থ আছে, যোগাযোগের। সবই অনিক বুঝতে পারে। ওই যেমন ধাপের কাছে ভাসতে থাকা কাঁঠাল পাতাটা একটু আগে দেওয়ালের শেওলাকে সম্ভাষণ করল। অনিক টের পেয়ে মুচকি হেসেছে। উত্তরের পারুল গাছের নিচে খুঁটে খাওয়া কাঠবেড়ালিটা অনিকের হাসি শুনে যে চমকে তাকাল, সেটাও অনিকের নজর এড়ায় নি। ব্যাটা নির্ঘাত ঘাবড়ে গেছে এই ভেবে যে, মানুষটা কি করে ওদের সব রহস্য জেনে যাচ্ছে। অনিক হাসি থামিয়ে এবারে গম্ভীর হয়ে গেল। শুধু গাছ, পাখি, পাথরের কানাকানি শোনার জন্যে তো আর সে এখানে বসে নেই। ঠায় অপেক্ষায় থেকে খুব ক্লান্ত লাগছে ওর। প্রতিদিন নানারকম কারণ দেখিয়ে অনিক কে বসিয়ে রেখে কি যে মজা পায় অলি!
বিরক্তিতে ভুরু
দুটো প্রায় জোড়া লাগতে যাচ্ছিল, তখুনি অনিক টের পেল, চারদিকের আলোতে একটু গোলাপি আভা,
আর তার সাথে কানে আসছে রিনরিনে চুড়ির শব্দ। গাছের কোটরের ডাহুক, ঘুঘুরা তাদের ঝগড়াঝাঁটি
বন্ধ রেখে এদিকেই তাকিয়ে আছে। তালপুকুর এখন কাঁচের মতন স্থির। অনিক বুঝল অলির আসার
সময় হয়েছে।
‘তুমি রেগে
গেছ অনিক?’
অলির সুরেলা
গলা অনিকের বুক ছুঁয়ে গেল। একটা চাপ ব্যাথা উঠল গলার কাছে দলা পাকিয়ে। ওটাকে অভিমান
বলে। মৌমাছিরা না এলে জুঁই ফুলেরও এরকম গোসা হয়।
‘অঞ্জলি দিতে
এলেনা কেন?’
‘কিসের অঞ্জলি
অনিক?’
খুব রেগে গেল
অনিক। রাগলে আবার মাথায় ব্যাথা হয়। একসাথে অনেক পিঁপড়ে কামড়ানোর মতন। তা স্বত্বেও রেগে
গেল সে। প্রতি বছর অনিক আর অলি স্বরস্বতি পুজোর অঞ্জলি দেয় পাশাপাশি। ছোটদাদু ঠাকুরমশাই
কে ডেকে বলেন, ‘এই উত্তম-সুচিত্রার মাথায় একটু বেশি করে শান্তির জল ছেটান’। অনিক আড়চোখে
দেখে, অলি লজ্জায় লাল। নিজেকে উত্তম ভাবার চেয়ে ওকে সুচিত্রা ভাবতে আরও ভালো লাগে অনিকের।
ছোটদাদু খুব মজার লোক, কথায়-কথায় ওদের পিছনে লাগেন। অনিক কে কাঁধে করে বিন্নাগরের হাটে
নিয়ে গিয়েছিলেন সেবার। ওখানে কত লোক আর নাগরদোলা। অনিক ঠোঙ্গা ভরে চিনেবাদাম খেয়েছিল।
ফুচকার দোকানও ছিল, কিন্তু ওর পেটে ব্যাথা বলে দাদু কিনে দেয়নি। ব্যাথা হবে নাইবা কেন।
আগের দিন পুকুরে জাল ফেলে কত-কত মাছ ধরা হয়েছিল। চার-পাঁচ রকম পদ বানিয়েছিল দিদিমা।
সারা গ্রামের লোক নেমন্তন্নে বসেছিল উঠোনে।
অনিক এক থালা মাছ নিয়ে, পাশে বসা অলির গালের তিলের দিকে তাকিয়ে ছিল। এঁটো মুখে গালে
একটা চুমু খেলে অলি কি রাগ করবে? আবার কোথা থেকে কোথায় চলে গেল অনিক। ওই ওষুধগুলোর
জন্যেই যত মুশকিল, ভাবনা চিন্তাগুলো কেমন যেন লাগামহীন হয়ে গেছে। অনিকের এখন অলির ওপরে
রাগ দেখানোর কথা, সেটা ছেড়ে কোথায় বিন্নাগরের হাট আর কোথায়ই বা সেই কালো তিল।
ঝিলমিল করে
হেসে উঠল অলি। ওকি বুঝতে পারছে অনিক কি ভাবছে? সবাই সব জেনে ফেললে তো খুব মুশকিল, নিজের
মতন করে ভাবার কিছুই থাকবে না। কিছু জিনিস ব্যক্তিগত থাকাই ভালো। অলি হাসলে শব্দ হয়না,
কেমন যেন আলোর অনুভূতি হয়। অনিক কোনোদিন অলিকে হাসতে শোনেনি, ওকে হাসতে অনুভব করেছে।
‘তুমি আমার
সাথে অঞ্জলি দিলে না যে আজ! আমি অপেক্ষায় ছিলাম, আর ছোটদাদুও’।
‘আজ তো কোনো
পুজো নেই অনিক। ছোটদাদুও সেই কবেই চলে গেছেন। তুমি অকারণে আকাশ পাতাল ভাবছ। এদিকে একবারও
তাকালে না। দেখবে নাকি আমাকে? কেমন লাগছি আমি?’
গোলমাল হয়ে
গেল অনিকের। তাহলে কি ওটা বিন্নাগরের হাট ছিল না? সেজোমামা খই ছড়াচ্ছিল আর কতগুলো লোক
গুনগুন করে ‘হরিবোল’ বলছিল। কত বয়স ছিল ওর? নাহ মনে নেই। অনিক বুঝতেই পারেনি ছোটদাদু
কে ঘুমাতে দিয়ে ওরা এত কাঁদছে কেন। চুল্লিতে আগুন লাগতেই হেসে ফেলেছিল ও। সবাই ভেবেছিল
অনিক মনের দুঃখে হাসছে। কিন্তু একদম নয়, বোকারা ভাবে পোড়ালেই সব শেষ হয়ে যায়। তাহলে,
কিভাবে ছোটদাদু দিব্যি ওকে ফুচকা খাওয়ানোর কথা বলছিল কানে কানে? মিত্তির কাকু ওইদিনই
বাবা কে ডাক্তারের খোঁজ দিয়েছিল, অনিকের জন্যে।
‘তুমি এত গোলাপি
কেন অলি? আমার চোখে ব্যাথা হচ্ছে তো’
অনিক বেশিক্ষন
তাকাতে পারলো না। পৈঠাতে মাত্র দু’হাত দূরেই বসে আছে অলি, কিন্তু বারংবার ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো
হয়ে যাচ্ছে কাঁচের মতন। পরক্ষনেই জুড়ে তৈরি করছে একটা ঝাপসা ছবি। কিছুতেই স্থির থাকছে
না। ওর হাসির টুকরোগুলো, গালের তিল, ঘাড়ের কাছের কোঁকড়ানো চুল সব কেমন একটা দুরন্ত
গতিতে পাক খেয়ে ছিটকে সরে যাচ্ছে। জ্বর হলে ছোটবেলায় অনিকের এরকম হত। চোখ বন্ধ করলেই
কতগুলো বাক্স আর বল ক্রমাগত ছোট থেকে প্রকাণ্ড বড় হয়ে গিয়ে মাথার ভিতরে দামামা বাজাত।
অনিক ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে জেগে ওঠার চেষ্টা করত। ওর কি আবার জ্বর এসেছে? ওর খুব
ইচ্ছে করছে অঞ্জলি দিতে, সেদিনের বাকি থেকে যাওয়া অঞ্জলি।
‘তুমি আবার
ছেলেমানুষি করছ অনিক। সেই কোন ছেলেবেলার কথা ভাবছ তখন থেকে। তোমার মনে পড়ে কবে আমরা
শেষ বারের মতন বসেছিলাম পাশাপাশি?’
অনিক মাথার
ভিতরে হাতড়াতে শুরু করে। গতকালই তো কথা হল। না না, কালও গুড়ো-গুড়ো কাঁচের মতন এসেছিল
অলি, যাকে ভালো করে দেখা যায় না। বোঝাই যায় না অবয়ব টাকে। ভাবনার অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে
পিছলাতে পিছলাতে থামল অনিক। একটা সিনেমার পর্দায় দেখতে পেল ছেলে মেয়ে দুটোকে, সোনালি
ধান খেতের পাশের কাঁচা রাস্তাতে হাঁটছে। ওই ছেলেটাও অনিক কে দেখতে পেল নাকি? কেমন অবাক
হয়ে তাকিয়ে আছে এদিকেই। মেয়েটার গলা অনেকটা অলির মতন, ‘তুমি বড় হয়ে আমায় বিয়ে করবে?’
একটা হ্যাঁচকা
টান অনিক কে ওই সিনেমার পর্দার সামনে থেকে এক লহমায় সরিয়ে আবার তালপুকুরের আলো ছায়া
ঘেরা ঘাটে এনে ফেলল। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছে অনিকের। সামনের দৃশ্যগুলোর এত দ্রুত
নড়াচড়া ওর চোখ নিতে পারে না। দু’হাতে চেপে হাঁটুতে মাথা গুঁজে রইল খানিকক্ষণ।
‘অলি, ওটা কি
আমরা? তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে? আমি নিশ্চয়ই হ্যাঁ বলেছিলাম, তাইনা? তারপরে কি
হল অলি? আমরা কি বড় হইনি? তোমাকে তো সেই ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি। খালি ভয় পেতাম তুমি
হয়তো সেরকম করে ভাবোনা। এই তালপুকুরের পাড়ে আমরা কত গল্প করেছি দুজনে মিলে, বেঁচে থাকার…’
চারিদিক আবার
চকচক করে উঠল, মানে অলি হাসছে। কিন্তু হাসছে কেন?
‘তালপুকুর তো
তোমার মনের কল্পনা অনিক। এরকম আবার কিছু আছে নাকি? মনে আছে ছোট্ট বাবুল বারান্দায় বসে
কবিতা পড়ছিল? বাবুদের তালপুকুরে… আর তুমি আমার ঠোঁটে ঠোঁট দিয়েছিলে দিদিমার পান সাজার
ঘরে।’
‘হ্যাঁ অলি,
মনে পড়েছে তোমার গোলাপি ঠোঁট’, অনিক আরেকটা মুভি থিয়েটারের ভিতরে বসে আবছা দেখতে পেল
ছবিগুলো। উঠোনের গাঁদাফুলের ওপরে গঙ্গাফড়িং আর এক বুক মোচড়ানো ব্যথা। অনিকের আরও কিছু
জিনিস মনে এল, ’তোমার গলায় কালশিটে ছিল। আমি কত জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে, কিন্তু তুমি
কিচ্ছু না বলে কোথায় যেন হারিয়ে গেলে। আমি দিদিমা কে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার কথা, কিন্তু
ওরা সবাই চমকে উঠে আমাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ওরা সবসময় তাই করে। কেন অলি? আমার
কি কোন রোগ আছে?’
তালপুকুরের
জল আর স্থির নেই, ঠিক মধ্যিখানে একটা গভীর গর্ত দিয়ে সব জল যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।
এরকম হয় নাকি? আগে কোনদিন দেখেনি অনিক। কিই বা যায় আসে। অলির কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে
এসবই ওর কল্পনা। এইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা খেই হারিয়ে দেয় সময়ের। কোনটা আগে, কোনটা পরে
সব তালগোল পাকিয়ে যায়। স্বরস্বতি পুজোর দিন অনিক কে মণ্ডপের সামনে দাঁড়াতে বলে অলি
বাসন্তী শাড়িতে সেজে আসবে বলেছিল। এসেছিল কি? বিকেলে বাগানে প্রজাপতির পিছনে ছুটে বেড়ানোর
কথা ছিল। সেটাও কি সেদিনই নাকি আরও অনেক পরে? আবার কয়েক জন্ম আগেও হতে পারে। অনিকের
আর কিছু মনে করতে ইচ্ছে করছে না। স্মৃতির দেরাজের চাবি হারিয়ে গেছে। চোখের মনির নড়াচড়ার
সাথে তলপেট গুলিয়ে উঠছে।
‘তোমার কোনো
রোগ নেই অনিক। তোমাকে ওরা বুঝতে পারে না। তুমি যে অনেক বেশী দেখতে পাও। অনেক ফিসফিস
তোমার কানে ধরা দেয়। আলোআঁধারির মাঝের পর্দাগুলো, যা কেউ খুঁজে পায়না, সেগুলো তুমি
সরাতে ভালবাস। সেই জন্যেই তো আমি তোমার কাছে আসি রোজই। যেমন কালকেও এসেছিলাম তোমার
তালপুকুরের ছায়ায়, যেমন তার আগের দিন, আর তারও আগে প্রতিদিন, বছরের পর বছর ধরে’।
স্বস্তির নিঃশ্বাস
ফেলল অনিক। যাক, তাহলে ও পাগল নয়। সকলে মিছিমিছি ওর দিকে অনুকম্পার চোখে এতদিন তাকিয়ে
এসেছে। শান্তি পেলেও কষ্টটা কিছুতেই যেন যায় না। প্রতিদিনই অলি একই ভাবে ওকে সাহস যোগায়,
ভরসা দেয়। অনিক হাত বাড়ালেই ভেঙ্গে ঝুরঝুর হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। তালপুকুরের পাশে
অনিক আবার একা বসে থাকে পরের অঞ্জলির নির্ঘণ্টের জন্যে। একসাথে দেওয়ার কথা হয়েছিল ওদের।
কোনো না কোনোদিন অলি নিশ্চয়ই আসতে পারবে।
দধিকর্মার দিন
পুকুরে জাল ফেলে এক জলপরী কে পাওয়া গেছিল। সেদিনই প্রথমবার জ্ঞান হারায় অনিক। ক’মিনিট
বা ক’ঘণ্টা বা ক’দিন ঘুমিয়ে ছিল খেয়াল নেই। হুঁশ ফিরতে অনিক দেখেছিল ছোটদাদু কে, আরাম
কেদারায় বসে উদাস হয়ে জালানা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। শুনেছিল বারান্দার চড়ুইরা নিজেদের মধ্যে
খাবারের ভাগ নিয়ে ঝগড়া করছে। মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিল দিদিমার সাদা থান আর তার পিছনে
অলির গোলাপি ঠোঁট আর কালো তিলের মুচকি হাসি। পরম নিশ্চিন্তে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল অনিক।
মাথার ব্যথাটাও সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল। আর ইদানিং এই কড়া ওষুধগুলো ওকে খুব দুর্বল
করে রেখেছে।
‘তুমি শুনতে পাচ্ছ অনিক? ওরা ভাবছে তোমার ঘুম আর ভাঙবে না, তাই যন্ত্রটা বন্ধ করে দেবে। জলপরীর অপেক্ষা থেকে এবার তোমার ছুটি। এদিকে একবার দেখ, আমি এসেছি সেই বাসন্তী শাড়িতে’।
মুচকি হেসে
উঠে দাঁড়াল অনিক। অবশেষে এই অনন্ত ঘূর্ণির হাত থেকে ছাড়া পাবে সে। এতদিনে চিনে ফেলা
তালপুকুরের প্রতিটা ঘাস, শ্যাওলাকে বিদায় জানিয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিল জলে। ঢেউগুলো ওকে
ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেল পুকুরের মাঝের গর্তের দিকে, যেখানে বিপুল জলরাশি প্রবল প্রপাত
সৃষ্টি করে হারিয়ে যাচ্ছে মহাশূন্যের অতল গহ্বরে। অলিকে ভালোবাসার কথা বলতে না পারার
যন্ত্রণা ওকে যে অফুরন্ত সময়ের বৃত্তে বন্দি করে রেখেছিল, আজ তার মুক্তি সেখান থেকে।।
এই গল্পের কোনো মন্তব্য হয় না। শুধু পড়তে হয়।
উত্তরমুছুন