রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২১

শাস্তি


তোমাকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন?’

হোটেলের বারান্দায়, চেয়ারে গা এলিয়ে রচনা পাহাড় আর মেঘের লুকোচুরি খেলা উপভোগ করছিল। অথচ, রঙ্গিত নদীর ধার ঘেঁসে উঠে যাওয়া সুউচ্চ হিমালয়ের নৈসর্গিক শোভা দেখে শান্তি পাওয়া দূরে থাক, অতনু আরও বেশি ধূমপান করছে। ওর মধ্যে সবসময় একটা চকিত, সন্ত্রস্ত ভাব। যেন, কারোর থেকে লুকিয়ে থাকতে চাইছে। জোরথাং ঘুরতে আসার পরিকল্পনাও আচমকাই ঠিক করেছিল অতনু। রচনা চায়নি ঝিলমিলের অযথা স্কুল কামাই হোক। তার চেয়ে বরং পুজোর ছুটিতে সিকিম ঘুরতে আসবে। ওর কোন আপত্তি কানে তোলে নি অতনু, বরং বাধা পেলে প্রচণ্ড অশান্তি করেছে। রচনা বুঝেছিল কোন অজ্ঞাত কারণে অতনু খুব মানসিক চাপে রয়েছে। অত্যন্ত চাপা স্বভাবের ছেলে সে। ওর কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাওয়ার বৃথা প্রয়াস করেনি রচনা। শেষপর্যন্ত, ঝিলমিলের স্কুলে ছুটি নিয়ে জুলাই এর ঘোর বর্ষায় সবাই মিলে জোরথাং এ হাজির হয়েছে। অতিথি শূন্য হোটেলে ঘর সহজে পাওয়া গেলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাইরে পা দেওয়ার সুযোগ দেয়নি। গত দু’দিন অতনু হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করলেও এই মুহূর্তে সে অস্বাভাবিক রকম চঞ্চল।  

‘ও…এখানেও আমার পিছু ছাড়েনি!’

রচনা দেখল সিগারেট পুড়ে অতনুর আঙ্গুল ছুঁয়ে ফেলেছে। ওর ভ্রূক্ষেপও নেই। বিগত কয়েক মাসে লোকটা খুব দ্রুত বুড়িয়ে গেছে। স্বামীর গলায় সুস্পষ্ট উদ্বেগের ইঙ্গিতে অজানা আশঙ্কায় রচনা কেঁপে উঠল। অতনু কি কোন খারাপ লোকের খপ্পরে পড়েছে?

'কার কথা বলছ, অতনু?'

সিগারেটের শেষাংশ মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে অতনু রচনার পাশে এসে মাথা নিচু করে বসল। ওর মুখ ফ্যাকাশে। কাঁপা গলায় বলল, ‘ওকে দেখতে পাচ্ছ না? খুব রেগে তাকিয়ে আছে এই দিকে’।

‘কোথায় কে? এই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কোনো গেস্ট নেই’, রচনা চারিদিকে আলগা চোখ বুলিয়ে বলল।

‘ঝিলমিলের পাশে যে মেয়েটা রয়েছে…একদৃষ্টিতে আমাকেই দেখছে’, অতনু যেন রচনার নেতিবাচক জবাবের জন্যে প্রস্তুতই ছিল।

‘ঝিলমিল তো একাই পাথর নিয়ে খেলছে সিঁড়ির কাছে। আমি সবসময় ওকে চোখে চোখেই রেখেছি’, রচনা অতনুর অমূলক ভয় ভাঙ্গার চেষ্টা করল। ছোট্ট ঝিলমিল একাই হাসছে, কথা বলছে। বাচ্চারা তো এমন করেই থাকে। হঠাৎ কাঁচের গ্লাসে মেয়ের প্রতিচ্ছায়া দেখে রচনার সারা গায়ে কাঁটা দিল। ঝিলমিলের শরীরের সাথে গা লাগিয়ে বসে আছে এক ধূসর অবয়ব। তার আকৃতি আবছা হলেও চোখ দুটি প্রকট। রচনা চমকে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। এর কথাই কি অতনু বলে মাঝেমধ্যে ঘুমের ঘোরে?

‘জানিনা তুমি কি ভাবছ, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ওকে দেখতে পাই সবসময়। আয়নায় আমার প্রতিবিম্বের পিছনে ও নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে দেখি মাথার কাছে পলকহীন চোখে ও আমাকেই দেখেছে। চলন্ত বাসের পাদানি, ট্রেন স্টেশন, এমন কি ট্যাক্সির সামনের সিট থেকেও মাথা ঘুরিয়ে সারাক্ষণ আমার প্রতি ঘেন্না ঢেলে যাচ্ছে। আমার কোনো নিস্তার নেই রচনা। যার ভয়ে শহর ছেড়ে এতদূরে পালিয়ে এলাম… সে খুঁজে-খুঁজে এখানেও হাজির হয়েছে’, অতনুর গলা ধরে এল। রচনার হাত নিজের বুকে টেনে ধরে, ডুক্‌রে, শিশুর মতন কেঁদে উঠল সে। নিতান্ত অসহায় হয়ে আজ ও আশ্রয় চাইছে সহধর্মিণীর কাছে। এতদিনের অব্যক্ত আতঙ্ক অশ্রুর অঝোর ধারা হয়ে সিক্ত করে দিচ্ছে রচনার দুই হাত।  

প্রায় এক বছরের ওপর, অতনুকে ভিতর থেকে কিছু একটা কুরে-কুরে খাচ্ছে তা রচনা আন্দাজ করেছিল। নৈমিত্তিক ঝগড়া, কোন্দলে ওদের সম্পর্ক তলানি তে পৌঁছালেও শুধু ঝিলমিলের হাত ধরেই কোনমতে সংসার টিকে ছিল। তাই, মনের ভিতরে অদম্য কৌতূহল হলেও অতনুর ব্যক্তিস্বাধীনতার উঁচু পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে তার কাছে যাওয়ার উদ্যম জোগাড় করে উঠতে পারেনি রচনা। সেই অক্ষমতার গ্লানি আর একসময়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটার অনিষ্টের আশঙ্কা এখন ওকে বিহ্বল করে তুলল। অনুভব করল, একটা অদ্ভুত সুবাসে ওর ঘ্রাণেন্দ্রিয় অবশ হয়ে আসছে। জুঁই ফুলের মতন গন্ধটা খুব চেনা রচনার। মাঝরাতে অনেকসময় যখন অতনু চিৎকার করে উঠে বসে, তখন সারা ঘরে এর মাদকতা  ছেয়ে থাকে।

‘কবে থেকে এমন হল অতনু?’, থর্‌থর্‌ করে কাঁপতে থাকা স্বামীকে দুহাতে আঁকড়ে জানতে চাইল রচনা। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা কালো মেঘ দ্রুতগতিতে উপত্যকায় গড়িয়ে অকাল সন্ধ্যে ডেকে এনেছে। বরফ শীতল কতগুলো ঘূর্ণি খোলা বারান্দায় পাক খেয়ে দুর্নিবার ক্রোধে ওদের চেয়ারের গায়ে আছড়ে পড়ছে। নিয়তি যেন অতনুকে রচনার বাহুপাশ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায়।

‘পিকনিক থেকে ফেরার সময় অ্যাকসিডেন্টটা মনে আছে? নেশায় ছিলাম সকলেই। ফুটপাথে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল ও’, অতনুর ফ্যাস্‌ফেসে গলায় আপসোসের গোঙ্গানি বমির মতন উঠে এল, ‘বাকি সবাই শেষ হয়ে গেছে। শুধু আমার শাস্তি বাকি রয়ে গেছে…’

মনে পড়ল রচনার, পিছনের সিটে ঝিলমিলকে বুকে চেপে আতঙ্কে চোখ বুজে থাকা। দুর্ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল সবাই। লুকনো অপরাধবোধ নিয়ে তারপরে সকলেই এদিক সেদিক আলাদা হয়ে গেছিল। কেউ ভুলেও খুঁজে দেখেনি সংবাদপত্রের এক কোণায় ছাপা খবরটা। কোলকাতায় ঘুরতে আসা পাহাড়ি মা মেয়ের অকাল প্রয়াণ মোমবাতির মিছিল তৈরির জন্যে যথেষ্ট ছিলনা।

রচনার ভাবনা খেই পাওয়ার আগেই একটা ভয়ানক হেঁচকা টান অতনুকে চেয়ার থেকে উপড়ে মেঝেতে ফেলে দিল। ওর শরীরটাকে বারান্দায় ঘষটাতে-ঘষটাতে কোন অদৃশ্য শক্তি নিয়ে গেল রেলিং এর কাছে। পাহাড়ের মাথায় প্রবল বর্ষণ বারান্দার ঠিক নিচ দিয়ে বহে যাওয়া রঙ্গিত নদিতে হড়কা বান এনেছে। ওখানে অতনু পড়ে গেলে ওর চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। রচনা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অতনুর গায়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। চারপাশের হিম-শীতল ঘূর্ণাবর্তগুলো একে একে জমাট বেঁধে ধোঁয়াটে, পুতিগন্ধময় চেহারা নিয়ে রচনার মুখের কাছে বীভৎস চিৎকার সহ রাগে ফেটে পড়ল। তার বিস্ফারিত চোখ আর বিকৃত অন্তহীন মুখ-গহ্বর রচনার সর্বাঙ্গ অবশ করলেও শরীরের শেষ বলটুকু একত্রিত করে সে অতনুর পা আর রেলিং জড়িয়ে থেকে নিশ্চিত মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখল। ঝিলমিলকে দেখতে পেল রচনা। খেলা বন্ধ করে, ঘাড় অস্বাভাবিক রকম ঘুরিয়ে জ্বলন্ত চোখে ঝিলমিল ওর দিকে নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে।

‘ঝিলমিল…!!!’, গলা চিরে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল রচনার। মূর্ছা যাওয়ার আগে কপালে ঝিলমিলের হাতের নরম পরশ পেয়েছিল রচনা, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে মা। ও বলেছে আমায়…’

******

নদীর গা ছুঁয়ে আসা ভেজা, ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি দিল রচনার। রঙ্গিত আজকে শান্ত। নির্মেঘ সান্ধ্য আকাশ সূর্যাস্তের লালচে রঙ মেখে আছে এখনও। মাঝখানে এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, তবু ভিতরের ক্ষতটা এখনও সবুজ। চোখ বুজলে সেদিনের ঘটনাগুলো ছবির মতন ভেসে এসে রচনার হুইল চেয়ারে আবদ্ধ শরীরে আতঙ্কের শিহরণ আনে। এই রেলিঙের পাশেই সেদিন অতনুর হার্ট ফেল করেছিল। রচনারও ব্রেনে ইন্টারনাল হেমারেজ হওয়ার জন্যে আংশিক পক্ষাঘাত হয়ে যায়। সেই অবস্থা থেকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে মেয়েকে একা হাতেই বড় করেছে রচনা। পড়াশুনা শেষ করে ঝিলমিল মাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে বলে ঝোলাঝুলি করলে রচনা নিজের থেকেই জোরথাং এর নাম বলে। বাবাকে ওর একেবারেই মনে নেই। সত্যি ঘটনা জানার মতন বয়স ঝিলমিলের হয়েছে ভেবেই রচনা ঠিক করেছে মেয়েকে সব খুলে বলবে। ওইতো সে, রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় ছবি তুলছে।

‘ঝিলমিল…একবার শুনবি মা’, রচনা শাল গায়ে জড়িয়ে মেয়েকে ডাকল। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে, এবারে ঘরে গেলেই ভাল। একটা সুগন্ধে মনটাও আবার উতলা। এখানে জুঁই ফুল ফোটে নাকি?

সাড়া না পেয়ে আরেকবার ডাকল রচনা, ‘কিরে! শুনতে পারছিস না? আমাকে ভিতরে নিয়ে চল।‘

ঝিলমিল এবারে মুখ ফেরাল, সেই আগের মতন। রচনার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল মেয়েকে দেখে। ঝিলমিলের মুখ শুকনো, ধূসর বর্ণের। বিকট আকৃতির চোখ দুটোতে সাদার লেশ মাত্র নেই। অসীম আতঙ্কে রচনা বুঝল, শাস্তি এখনও বাকি রয়ে গেছে।।

1 টি মন্তব্য:

আপনাদের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া জানান